পপ শা 124 0101২/1 1107/111 91111011611 ৬১৬ /১-374৯1২4৮11 1,190 4 ৩ সি রি পা ঝা 251155 [১55 ছবশশলট 35 তুপ্ণে্ছ স্্্ ্সওছ কণ্যাপক্ষ, রদ রে গতি পাৰ্ঃনিনং বপন তা--৭ ৯৩, মহাতআ গান্ধী রোড, কলিক দ্বিতীয় ঘুদ্রণ, ২২৭* সংখ) কাতিক, ১৩৩৬১ তৃতীয় মুদ্রণ, ৩৩০০ সংখ্য| বৈশাখ, ১৩৬২ চতুর্থ মুদ্রণ, ২২** সংখ্যা চৈত্র, ১৩৬২. প্রথম সংস্করণ: পঞ্চম মুদ্রণ, ৩৩০, সংখ "ই শ্রাবণ ১৩৪১ কাতিকঃ ১৩৬৩ ষ্ঠ মুদ্রণ, ৩৩০* সংখ্যা অগ্রহায়ণ, ১৩৬৪ ৃ সপ্তম মুদ্রণ, ২২৭* সংখ|! জ্যেষ্ঠ, ১৩৬৬ তিন টাক। প্রচ্ছদসজ্জ। ; অজিত গুপ্ত প্রকাশক £ শ্রীজিতেন্্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বি, এ »৩ মহাত্ব গান্ধী রোড, কলিকাতা”? মুদ্রাকর ঃ গ্রীঅজিত ঘোষ, শরৎ-প্রকাশ মুদ্রণ, ৬৪|এ, ধর্মতলা ছ্রীট, কলিকাতা-১৩ উরস প্ীশিবদ 1স চটোপা ধ্যায় বন্ধুবরেষু “কন্ঠাপ্ক্ষ” উপন্যাস নয় । উপন্যাসের প্রচলিত যা সংজ্ঞ। তার আওতায় এ পড়ে না । কিন্তু ছোটগল্লের বই-ও নয় এ। কেন নয়, ত| বুঝিয়ে বল! দরকার । সব কিছু জড়িয়ে বে সামগ্রিক এব অখণ্ড আবেদন উপন্যা।সের অন্যতম লক্ষণ, এ-গ্রন্থে তা আছে । এ-ছাড়! আরও একটি কারণ আছে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে কিছু বিচিত্র চরিত্রের সন্ধান পেয়েছিলাম আমি । সচেতনভাবে চিত্রশিল্পীদের মতো তার কিছু ন্বেচে করে রেখেছিলাম তখন উদ্দেশ্ত ছিল বৃহৎ পটভূমিকায় এগুলো! বৃহত্তর প্রয়োজনে লাগাষে। | কিন্তু ইতিমধ্যে একদিন তার ভেতরে এঁক্য, সামগ্রস্ত আর ক্রম- পরিণতির এক আভাস লক্ষ্য করেছি। তাই সেগুলির কি ছু অংশ একত্র করে এখন গ্রস্থাকারে রূপ দিলাম । তা ছাড়! আম।র সাহিত্য-জীবনের একটি পুরনে। অধ্যায় হিজেবেও আমার কাছে এর উপযোগিত1 আছে । ৭ই শ্রাবণ, ১৩৬১ বিমল মিত্র লেখক জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি এই যে, তাকে সারা জীবন ধরে লিখতে হবে এবং আজীবন ভালে। লেখাই লিখতে হবে। একখান! ভালে। বই লিখে থেমে গেলে চলবে না। একখানা ভালে। বই লিখেছে বলে, পরের বইটা! খারাপ লিখলেও কেউ তাকে ক্ষমা করবে না। শুধু ভালো লিখতে হবে তাই-ই নয়। আরো ভালো। আরো, আরো ভালো । উত্তরোত্তর ভালে। এ-সব কথা আমার নয়। এত কথা আমি বুঝতাম না। এ-সব কথা আমাকে যে শিখিয়েছিল, তাকে আমার গল্পের মধ্যে কখনও টেনে আনিনি। আমার জীবনের শেষ গল্প আমি লিখবো হয়ত তাকে নিয়েই । কিন্তু সে- কথা এখন থাক্‌ কিন্তু কাকে নিয়ে 'কন্ঠাপক্ষ সুরু করি ! অলক! পাল, সুধা সেন, মিষ্টিদিদি, মিছরি-বৌদি, আমার মাসিমা, কালোজামদিদ্ি, মিলি মল্লিক--কার কথা ভালো করে জানি! কাকে ভালো করে চিনেছি ! আমার জীবনের সঙ্গে কে জড়িয়ে গিয়েছিল সবচেয়ে বেশি করে! ছোটবেলা থেকে কত জায়গায় তো ঘুরেছি! কত কিছু দেখেছি! সকলকে কি মনে রাখা সহজ ! জব্বলপুরের সেই নেপিয়ার টাউন, বিলাসপুরের শনিচরী বাজার, কলকাতার সেই হাঙ্গারফোর্ড স্্রীটে মিষ্টিদিদির বাড়ি, পলাশপুরের মিলি মল্লিক--কত জায়গায় কত লোককে দেখলাম, আমার নোট-বইতে সকলের সব গল্প লিখে রাখিনি। শুধু ছু' একট! টুকরেো'-টাকর! টুকি-টাকি স্কেচ সব, তাই নিয়েই এই কন্যাপক্ষণ | সোনাঁদি বলতো, “যা-কিছু দেখছিস টুকে রাখ। আর্টিস্টরা যেমন স্কেচ করে খাতায়, তেমনি করে, তারপর যখন উপন্যাস লিখবি তখন কাজে লাগবে তোর ।; কন্তাপক্ষ উপন্যাসের কাজে কোনদিন লাগবে কিন। জানি না, তবু অনেকদিন ধরে যেখানে যা-কিছু দেখেছি, তার কিছু কিছু লিখে রেখেছি। এক-একটা মানুষ দেখেছি, আর যেন এক-একট মহাদেশ আবিষ্কারের আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছি । এক-একজন মানুষ যেন এক-একট। তাজমহল । তেমনি সুন্দর, তেমনি বিম্ময়-মুখর, তেমনি অশ্রু-করুণ ! ইচ্ছে ছিল, একদিন একখানা উপন্যাস লিখবো । এমন উপন্যাস ষে, পৃথিবীর সব মানুষ তাদের নিজের ছায়া দেখতে পাবে তাতে। অসংখ্য চরিত্রের শোঁভাযাত্রা। হাজার হাজার মানুষের মর্মকথা মুখর হয়ে উঠবে সে-উপন্যাসে। সে হবে দ্বিতীয় মহাঁভারত। সে আশা আমার সার্থক হয়নি জানি। হবেও না। তবু সোনাদি আশা দ্রিতো, “কেন পারবি না তুই, নিশ্চয় পারবি- নগদ পাওনার লোভ যদি ত্যাগ করতে পারিস, পুরুত হয়ে পুজোর নৈবিদ্য যদি চুরি না করিস তো, একদিন দেবতার প্রাসাদ পাবি তুই নিশ্চয়ই । মনে আছে, ছোটবেলায় একমাত্র সোনাদির কাছেই যাঁকিছু উৎসাহ পেয়েছি। যখন লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলেছি, বাবা দেখতে পেয়ে রাগ করেছেন, বন্ধু-বান্ধবরাও ঠাট্টা করেছে__-তখনও কিন্তু সোনাদি হাসেনি। সোনাদি বলতো, “মেয়েদের নিয়ে লেখাই শক্ত, মেয়েদেরই ভালে! করে লক্ষ্য করবি। মেয়েরা যেন ঠিক মঙ্গলগ্রহের মতো, এত দূরে থাকে তবু তার সম্বন্ধে পৃথিবীর লোকের কৌতৃহলের আর শেষ নেই। মঙ্গলগ্রহে পৌঁছুবাঁর জন্যে কি মানুষের কম চেষ্টা, কম অধ্যবসায়! কিন্তু যদি কখনও পৌছুতে পারে সেখানে- জিগ্যেস করতাম, “পৌছুলে কী দেখবে, সোনাদি ? 'তা কি বলতে পারি! কেউ হয়তো ঠকবে, কেউ জিতবে । হারজিত নিয়েই তো জগৎ। কিন্তু যে-মানুষের দুরত্ব নেই, তার সম্বন্ধে কোনো মানুষের কোনো কৌতৃহলও আর নেই। মেয়েদের রহস্যময়ী করে সৃষ্ট করার কারণই তো তাই-_ গু কন্তাপক্ষ কিন্তু সুধা! সেনকে যখন প্রথম দেখি তখন সত্যিই কোনো কৌতৃহল, কোনো রহস্ত আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি । তাই পরে যখন একদিন সুধা সেনের চিঠি পেলাম, সেদিন সত্যিই চমকে উঠেছিলাম । মনে আছে সুধা সেনকে নিয়ে যেদিন প্রথম রাস্তায় বেরিয়েছিলাম নিজেরই কেমন লজ্জা হয়েছিল যেন। সুধা সেন এমন মেয়ে নয় যাকে নিয়ে রাস্তায় বেরোনে চলে । ট্রাম-রাস্তার মোড়ে কারে সঙ্গে দেখ। হয়, এট। ইচ্ছে ছিল না আমার সেদ্িন। স্ধা সেন তেমন মেয়ে নয়, যাকে সঙ্গে করে বেড়ালে লোকের ঈর্বার উদ্রেক করা যায়। বরং উল্টো । বছর বাইশ বয়সের মেয়ে এমন রোগা স্বাস্থ্যহীন কেমন করে হল ? কীাধ-ঢাকা ব্লাউজের বাইরে হাত ছুটোর যে অংশ নজরে পড়ে, সেখানে সৌন্দর্যের আভ! কি যৌবনের মাধুর্য এতটুকু খুঁজে পাওয়া যায় না! গলার ছু'পাশে কার হাড় ছুটো স্পষ্ট- উচ্চারিত উদ্ধত ভঙ্গিতে আত্মঘোষণা করে। চোখের যে-দৃষ্টি থাকলে অন্তত যুবতী বলে মনের নিভূতেও একটু চাঞ্চল্য জাগে, তাঁও নেই তার। সে-দৃশ্যটা আজো আমার মনে আছে। সুধা যেন আমারই পাশে দাড়িয়ে আছে। নিতান্ত ঘনিষ্ঠ হয়েই দাড়িয়েছে আমার বা-পাশে । হাতে একট। ভ্যানিটি-ব্যাগও আছে, পায়ে মাঝারি দামের স্তাণ্ডেলও আছে, হাতে চুড়িও আছে ছু'গাছা' করে। সি'ছুরের একটা টিপও দিয়েছে সুধা! সেন ছুটে। ভুরুর মধ্যে। একটা জমকালে। রঙিন শাড়িও পরেছে । অর্থাৎ সাজবার ছূর্দম স্পৃহ! না থাক্‌, তবু অন্বীকার করবার উপায় নেই যে স্তুধ। সেন সেজেছে। ্ুতরাং এমন একটি মেয়েকে পাশে নিয়ে চলতে সেদিন লক্জবাই হচ্ছিল মনে আছে। হুর্ভাগ্যক্রমে এই অবস্থাতেই কি মোহিতের সঙ্গে দেখা! হয়ে যেতে হয় ! এড়ানো সম্ভব হলে হয়ত এড়িয়েই যেতাম । কিন্তু মোহিতই আমায় দেখে ফেলেছে । এগিয়ে এসে বললে, “কী রে, কোথায় ? বললাম, “একটা উপকার করতে পারে। হে? কন্তাপক্ষ ৪ তারপর সুধ। সেনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললাম, “আমার বৌদির বিশেষ জানাশোনা, বড় মুশকিলে পড়েছেন। থাকবার একট ঘরের বিশেষ দরকার। মেয়েদের বোভিং, ন! হয় মেস, যেখানে হোক । একে- বারে যাকে বলে নিরাশ্রয়। একটা বাসার খবর দ্রিতে পারো ? মোহিত নান। কাজের মানুষ। নান! দরকারে নান। জায়গায় যেতে হয় তাকে । বার ছুই সিগারেটে টান দিলে । কপাল ফুঁচকে একবাঁর ভাবলেও যেন। তারপর বললে, “আপাতত তো! কিছু মনে পড়ছে না ভাই, তবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বোভিং-এ একবার চেষ্টা করে চ্যাখো না চেষ্টা করে দেখতে আপত্তি নেই । মোট কথ। আজকের মধ্যে যেখানে হোক একট। আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করতেই হবে। সুধা সেনকে আমারই হাতে ছেড়ে দিয়েছে বৌদি। সুধা মেনের একটা থাঁকবার ব্যবস্থা আজ ন৷ করলেই নয়। এই বিরাট কলকাতা শহরে স্ুধা'সেন নাকি একেবারে সহায়- হীনা। আজ রাতটুকুর জন্যেও মাথা গৌঁজবার আশ্রয় নেই তার কোথাও । স্থধা সেনের মুখের দিকে চাইলাম। ভারি অসহায় মনে হল তাকে ! কে জানে এতদিন এই স্বাস্থ্য দিয়ে বি. এ. পাস করেছে কেমন করে, কেমন করে সাপ্লাই অফিসের আাকাউণ্টস্‌ সেক্সনে আশি টাঁকা মাইনের চাকরি করছে । পাঁড়ার্গায়ে নাকি ছোটবেলায় মান্ুধ। ছোটবেলায় মানে, ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েছে দেশেই। বৌদি বলে, "ভীষণ কিপটে মেয়েটা, কিছুতেই পয়সা খরচ করবে না, দিন ভোর শুধু সাত-আট বার চা খেয়েই কাটায় । ট্রাম এসে গিয়েছিল । মোহিত বললে, ছ্যা, আর একটা জায়গা! মনে পড়েছে, গোঁয়াবাগানে মেয়েদের একট! বোডিং আছে, সেখানে একবার চেষ্টা করতে পারো, বোধ হয় জায়গা পেতেও পারো-, ট্রামে উঠে পকেট থেকে নোট-বইটা বার করে ঠিকানাটা লিখে রাখলাম। কোথায় বালিগঞ্জ, কোথায় গোয়াবাগান, কোথায় হাারিসন রোড। শেষে যদি কোথাও জায়গা না মেলে তখন আমার কী কর্তব্য ভেবে পেলাম না। কিন্তু সুধা সেনের মুখের দিকে চাইলে সত্যিই মায়া হয়। ৫ কম্তাপক্ষ বৌদি বলে, “অফিসে একদিনও কিছু খাবে না, নেহাঁত যখন খুব খিদে পাবে তখন খালি এককাপ চা_-তাই তো ওইরকম স্বাস্থ্য ৷ একট বসবাঁর জায়গা পেয়েছিলাম । জানালার দিক ঘেষে সুধা সেন বসেছিল । বললাম, “বৌদি বলছিল, আপনার এক ভাই থাকে কলকাতায়--? সুধা সেন বললে, “এক ভাই নয়, ছু'ভাই-_ছু'জনে ছু"বাসায় থাকে ॥ “আপনার আপন ভাই ? তা সেখানে তাদের কাছে কোনরকমে ন্থধ! সেন বাইরের দিকে চোখ রেখেই বললে, আমার টিউশানিটা। যাবার পর থেকে তো ভায়েদের কাছেই আছি ।, 'আপনি টিউশানি করতেন নাঁকি ? স্বধা সেন বললে, €“সইথানেই তে। এ ক'বছর কাটিয়েছি, আমার স্্যুট- কেট এখনও সেখানে সেই বাসাতেই পড়ে আছে । একটা ছোট ছেলেকে পড়াতে হত। তারা নোটিস দিলেন। ছেলে বড় হয়েছে, এবার পুরুষ টিচারের কাছে পড়বে । লোক তারা খুব ভালে! । আমাকে এক মাসের নোটিস দিয়েছিলেন । বলেছিলেন,-এক মাসের মধ্যে কোথাও একট। বাসা-টাস! খুজে নিতে |; তারপর “একটা মাস তো দেখতে দেখতে কেটে গেল । একখান। ঘর পাঁওয়। গেল না যে, তা নয়। কিন্তু মেয়েদের থাকবার মতো সে-ঘর নয়। আর, এক-একজন য। ভাড়া চেয়ে ববলে।! আমি তো৷ আশি টাক মাইনে পাই, তা থেকে দেশে মাঁকেই বা কী পাঠাই, আর নিজের খরচই বা কিসে চালাই !, কল্পনা করলুম, সুধা সেন সারাদিন অফিসের চাকরি করে সকালে- সন্ধোয় ছাত্র পড়িয়ে বাসা খুঁজতে বেরিয়েছে । শ্যামবাঁজার, বউবাজার, টাল! আর টালিগঞ্জ । যেখানে এতটুকু পরিচয়ের সুত্র আছে, সেখানেই সন্ধান নেওয়!। তারপর ট্রামের ভিড়। সে-ভিড়ে পুরুষ মান্ুষেরাই উঠতে পারে না তো। সুধা সেন তো। চেপটে যাবে! একটা আচমকা! ধারক! খেয়েই কন্তাপক্ষ ৬ তো উল্টে পড়বে রাস্তায়। হয়তো ধাক্কাও খেয়েছে অনেকদিন । সৌন্দর্যের আভিজাত্য থাকলে লোকে তবু একটু সম্ত্রম সমীহ করে । খাতির করে। সুধা সেনের সে স্ুববিধেও নেই । এই তে সেদিন দেখলাম, ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠতে যাবার সময় একজনের চোখের সান-গ্লাসট। ছিটকে রাস্তায় পড়ে চুরমার হয়ে গেল। কতবার রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে যে-সব অত্যাচার অপ- মান সইতে হয়েছে, সেসব কি আর সুধা সেন মুখ ফুটে বলবে ? বললাম, “ধরুন, আজ যদি কোনো ব্যবস্থা না হয়, তাহলে কী উপায় ? “তা হলে ?-- বলে ভাবতে লাগলো সুধা সেন। “আপনি একট! কিছু ব্যবস্থ। করে দিন আমার । আপনি নিশ্চয় একট! ব্যবস্থা করতে পারবেন, আপনার বৌদির কাছে শুনেছি আপনার অনেক লোকের সঙ্গে জানাশোন। আছে ।- আধা সেন আমার চোখের ওপর মোখ রেখে বললে । লেডিন্‌ সীটে বসেছিলাম। ইতিমধ্যে একজন মহিল! ওঠায় জায়গ ছেড়ে দাড়াতে হল। আমি যেন বাঁচলাম। বৌদি বলেছিল, “ভারি ছট্ফটে মেয়েটা । কেবল এ-অফিস থেকে সে- অফিস করবে । কেবল কিসে উন্নতি করবে, বেশি টাক! জমাঁবে সেই ইচ্ছে -মোটে খাবে ন। কিছু, পয়স। যেন ওর গায়ের রক্ত ।, সুধা সেনের পাঁশে যে মেয়েটি এসে বসলো সে পাঞ্জাবী । ন্ুধা সেন তার পাশে যেন এতটুকু বিন্দুবং হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি সুধা সেনকে দেখে মায়া হয় না, দুঃখ হয় না। হাসি পায়। সাপ্লাই অফিসের অন্য মেয়েদেরও তে। দেখেছি । অনেক বিবাহিতা মহিলা, পাঁচ-ছ” ছেলের মা, অনেকেই তে! চাকরি করে। আবার কারোর চাকরি করবার প্রয়োজন নেই, শুধু শখ, তাও দেখেছি । সাজগোজ পোশাক-পরিচ্ছদ, সেই পয়সায় সিনেমা-থিয়েটার রেস্ট,রেন্ট সবই চলে । ধর্মতলার খাবারের দোকানটাতে ছুপুরবেল! মেয়েদের ভিড়ে ঢোকাই যায় না। কিন্তু সুধা! সেনের মতো মেয়ে সত্যিই দেখ! যায়নি এর আগে । এত রোগ মেয়ে আগে নজরেও পড়েনি আমার। বছর বাইশ বয়সের মেয়ে এমন স্বাস্থ্যহীন কেমন করে: ৭ কন্ঠাপক্ষ হল | সুধা সেন যখন হাটে, তখন মনে হয় সে যেন তাঁর কানের পাতল। ছুটে! ছুলের মত টিকটিক করে ছুলছে। হাঁটছে তাকে বল! চলে না ঠিক । দু'জনের ছুটো টিকিট আমিই কিনেছিলাম । কিন্তু সুধা সেনের সে সম্বন্ধে বিশেব চিন্তার কারণ নেই। টিকিট কেনা হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন তাঁর মনে উঠতে পারে না । ধর্মতলার মোড়ে ট্রাম থেকে নামতে হল। আর একটা ট্রামে উঠতে হবে এখানে । শ্যামবাঁজারের ট্রামে উঠে বললাম, “কোথায় আগে যাবেন? গোয়া- বাগানে, ন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বোডিং-এ ?' সুধা সেন বললে, চলুন আগে শেয়ালদ'য়। আমার ছোড়দা ওখানে থাকে শুনছি |? বললাম, “আর আপনার বড়দ। ? তিনি কোথায় থাকেন ?' স্থধা সেন বললে, “সই বড়দার বাঁড়িতেই তো। রাত্রে শুই, কিন্তু সেখানেও রাত বারটায় আগে ঢোকবার হুকুম নেই, তারপর ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে-থাঁকতে সকলের দ্বুম থেকে ওঠাঁর আগেই বেরিয়ে চলে আসতে হয়।, “কেন? সুধা সেনের কথা শুনে অবাক হবাঁরই কথ । নধ। স্ন যা বললে, তা শুনে আরো অবাক্‌ হয়ে গেলাম । সুধার বড়দ। ফড়েপুকুরে বিয়ে করে বউ নিয়ে সংসার পেতেছে। সেখানে থাকবার জায়গ।ও আছে বেশ। একখান ঘর খালি পড়েই থাকে । ভারি ভাঁলমান্থুষ কিন্তু বড়দা। কারো মুখের ওপর কথ! বলতে পারে না। কতদিন বড়দ। স্থধা সেনের অফিসে এসে আগে আগে খবর নিয়ে যেত। টাকার সাহায্য অবশ্য সুধা সেনের প্রয়োজন হয় না। তবু বৌদি কিছুতেই সুধা সেনকে সেখানে ঢুকতে দেবে না । কিন্তু বড়দ! খুব ভালবাসে ছোট বোনকে । যখন বৌদি ঘুমিয়ে পড়ে, রাত বারটার পর বড়দ। চুপি চুপি দরজ। খুলে দিয়ে যায়। নিংশবেঃ আলে না জেলে সুধা সেন তার নিরিষ্ট ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আবার সকাঁলবেলাই সকলের আগে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসতে হয় রাস্ত।য়। কন্ঠাপক্ষ ৮ বললাম, তারপর স্নান খাওয়া, এসব ? সুধা সেন বললে, 'ম্নানট। এতদ্দিন ছোড়দার ওখানেই করতুম | বউ- বাজারে একটা মেস করে আছে ছোড়দারা কয়েকজন বন্ধু মিলে''*ওরা এতদিন আপত্তি করে আসছিল । সকালবেল! সবাই অফিস যাবে, আর আমি তখন কলঘর জোড়া করে থাকি--সকলের বড় অসুবিধে হয়।? বললাম, শোয়া, মান করা তো। হল-_-এরপর খাওয়া ?' খাওয়ার আর ভাবনা কি? না খেলেই হয় !, সুধা সেন হাসলে । বৌদি ঠিকই. বলেছে,__মেয়েটা ভারি কিপটে। কিছু খাবে না, খাবে কেবল চা। কাপের পর কাপ চা। নইলে খুব খিদে আছে। যদি খায় তো! বড় জোর সিঙ্গাড়া, কচুরি, নয় তো বেগুনি, ফুলুরি তেলেভাজা। এই তেলেভাজা খেয়েই এক-একদিন কাটিয়ে দেয় সুধা সেন। এক-একদিন শ্রেফ কিছুই খায় না। প্রথম প্রথম নাকি কষ্ট হত সুধা সেনের, কিন্তু আজকাল অভ্যেস হয়ে গেছে। বড়দার বাড়িতে রাত বারটার আগে ঢোকবার হুকুম নেই, মথচ অফিস ছুটি পাঁচটায়। এই সাত ঘণ্টা কাটাতেই বড় কষ্ট হয়। কার্জন পার্কের জনবহুল অংশটায় কাটানোই সবচেয়ে নিরাপদ । কিংবা ট্রামে চড়ে একবার ডালহৌসি আর একবার বালিগঞ্জ স্টেশনও করা যায়, কিন্ত অকারণে অনেকগুলো পয়সা খরচ! কার্জন- পার্কের খোল হাওয়ায় ঘাসের ওপর বসে ছ”পয়সার চিনেবাদাম চিবিয়ে চিবিয়ে খেলে পেটটাও ভরে, খোল! হাওয়া খাওয়াও হয়, আবার সময়টাঁও বিনা খরচে কাটানো যাঁয়। সুধা সেন বললে, বিড়দা ছোড়দা কেউ মাকে টাকা পাঠায় না। সেখানে আমার একট। ছে'টি ভাই আছে, আমাকেই তার খরচ দিতে হয়|, বড়দা নাকি বিয়ের আগে টাকা পাঠাতো।। কিন্তু ইদানীং বৌদি বারণ করে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ির কোন লোককে দেখতে পারে না বৌদি। ছোড়দা তে। দার্দার সঙ্গে সমস্ত সংশ্রব ত্যাগ করেছে-_সুধা লেন বাধ্য হয়েই রাত্রে যায় শুতে, নইলে বৌদি দেখতে পেলে বড়দাকে তো আর আস্ত রাখবে ন।। ৯ কন্তাপক্ষ সুধা সেন বললে, “ছোড়দার মেসট। ছিল এতদিন, তবু সকালবেলা কাপড়-কাঁচা, স্নান করাট। হচ্ছিল । কিন্তু ছ'দিন থেকে তাও হয়নি--আজ দু'দিন সান করাঁও হয়নি আমার |, বেন “ছোড়দা ও-মেস ছেড়ে দিয়ে শেয়ালদ'য় একটা বড় হোটেলে উঠেছে। সেই জন্যেই বলছিলুম, আগে শেয়ালদ'য় গিয়ে ছোড়দাঁর খোঁজটা করি-- শেষ পর্যন্ত শেয়ালদ'র মোড়েই ট্রাম থেকে নামলাম । সুধা সেনকে নিয়ে এখানে ঢুকতে কেমন যেন লজ্জা ও সংকোচ বোধ হল। ম্যানেজার কিন্তু চিনতে পারলেন না। বললেন, 'অমলেন্দর সেন? না মশাই, এখানে ও-নামে কেউ থাকে না। সুধা সেন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল। অথচ সে ছোঁড়দার মেসে গিয়ে শুনেছে, এখানেই উঠেছে ছোড়দ1। আমি বললাম, “এখানে কোনো ঘর পাওয়া! যাবে, মানে আলাদা ঘর একটা, ইনি থাকবেন ।, ম্যানেজার সুধা সেনের দিকে চাইলেন । কেমন যেন বক্র-দৃ্টি। অস্তত সুধা সেনকে কেউ বক্র-দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারে, এ-ধারণা আমার ছিল না। ইতিমধ্যে ছু'এজজন ওয়েটার, চাপরাসী. ক্যাশিয়ার তারাও এসে দাড়িয়েছে চারপাশে । সুধা সেন আর আমাকে জড়িয়ে সবাই মিলে যেন একট সম্পর্ক কল্পনা করে নিয়েছে । জিনিসটা আমার ভালে! লাগলো না। ক্যাশিয়ার বললে, “কী বললেন স্যার, অমলেন্দ্ সেন? হ্থ্যা হ্যা, ছিলেন এখানে তিনি, কিন্ত তিনি তো।..'আচ্ছা, ওইখানে দেখুন তো, পাশেই যে গলিটা, ওর শেষে একেবারে লাল রঙের দৌতল। বাঁড়িটায় বোধ হয় তিনি আছেন-_ওই হোটেলে একবার চেষ্টা করে দেখুন তো-_, সকলের কৌতুহলী দৃষ্টি পার হয়ে সুধা সেনকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে যেন বাচলাম। আমার সম্বন্ধে কী ভাবলে ওর! কে জানে । ব্যাপারটা সুধা সেন বুঝতে পেরেছে নাকি? কিন্তু ওর মুখ কন্তাপক্ষ টিসি দেখে তা বোঝবার উপায় নেই। তেমনি ভাষাহীন বিবর্ণ মুখ ওর। হাতের ভ্যানিটি-ব্যাগটি নিয়ে বেশ চঞ্চল পায়ে আমার পাশে পাশে চলতে লাগলো স্থধা সেন। লাল রঙের দোতল। বাড়িটায় ঢোকা গেল। একটু নির্জন মনে হল বাড়িটা । ঘরগুলে। তালাচাবি দেওয়া । ছুটির দিন। সবাই বোধ হয় যে-যার দেশে চলে গেছে। রান্নাঘরের কোণে ঠাকুর থালায় ভাত বেড়ে খাবার আয়োজন করছে । বললে, 'অমলেন্দুবাবু? ওই সাত নম্বর ঘরে দেখুন ।” সাত নম্বর ঘর খুঁজতে অগ্রসর হচ্ছিলাম ৷ ঠিকান। বদলালো, অথচ বোনকে একটা খবর দেওয়াও প্রয়োজন বোধ করেনি-__-এ যেন কেমন। সুধা সেন কি এখানে থাকতে পারবে ? এ যেন হেটে মেস বলে মনে হল। এক ভদ্রলোক ভিজে গামছ। পরে এক বালতি জল বয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকছিলেন। বললেন, “হ্যা, এই ঘরেই থাকেন, কিন্তু এখন তো। তিনি নেই। সক্কালবেল! বেরিয়ে গেছেন, আসবেন সেই রাত্রে, আবার না-ও আসতে পারেন। বলে গেছেন, ওবেল। খাবেন না ।' সুধা সেনের দিকে তাকালাম । সুধা সেনও আমার দিকে তাকালে । বুঝলাম--ছোড়দাকে পাবার আশা যেন সে করেনি । শুধু ছোড়দার আস্তানাট! চিনে রাখতেই এসেছিল । সুধা সেন নিবিকারভাবে বেরিয়ে এল বাইরে । আমিও এলাম পেছনে পেছনে । সুধা সেন বললে, “ছোড়দার দেখা পাওয়। যাবে না জানতাম--ও ছোটবেল। থেকেই ওমনি! দশ বছর বয়সে দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিল কলকাতায়, মাকে একট! চিঠি পর্যস্ত দেয় ন। ।” শুনে আমি চুপ করে রইলাম। সুধা সেন আবার বলতে লাগলো, 'বড়দার ওপরেই মার বেশি ভরস। ছিল। জমি-জায়গ! বেচে বড়দাকে বাবা পড়িয়েছিলেন। আর বলতেন,-_ কমলটাই মান্ুষ হবে।, বললাম, “মানুষ তো যা হয়েছে, বুঝতে পারছি ।' ১১ কন্তাপক্ষ ধা সেন বললে, 'বড়দাই তে। আমার পড়ার খরচ সব দিত, মাকেও টাকা পাঠাতো, কিন্তু বৌদি আসার পর থেকেই সব বন্ধ করে দিয়েছে । আমাকেও বৌদি মোটে দেখতে পারে না। বড়দা এই ব্যাগটা আমায় কিনে দিয়েছিল আমার জন্মদিনে ) বললাম, এবার তাহলে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বোডিংট। দেখ। যাক-_+ স্বধা সেনকে নিয়েই আজ সমস্তট। দিন কাটবে মনে হল। অথচ রাস্তার মধ্যে ফেলে চলে যাওয়াও যায় না। কোথাও একরাত্রির জন্যেও ষদি থাকবার একট। বন্দোবস্ত কর! যেত আমি নিশ্চিন্ত হতাম । অফিসে যে-সব মেয়েরা সুধা সেনের সঙ্গে কাজ করে তারাও কী আশ্রয় দেন না একে ! কেজানে স্ুধ। সেনের কোথায় গোলযোগ । নিশ্চয় একটা খু আছে কোথাও সুধা সেনের চরিত্রে, যা তাঁকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়দের কাছে থেকে দুরে সরিয়ে দেয় । বৌদিকে জিগ্যেস করেছিলাম । বৌদি বলেছিল, “বড় কিপটে মেয়েটা, না-খেয়ে ওর মতো! থাকতে আর কাউকে দেখিনি | কিন্তু কৃপণতা কি এতবড় একটা অপরাধ নাকি যে কারো সহান্ুভূক্চি ভালোবাস বন্ধুত্ব পাবে না। যে কৃপণতা করে সে তো নিজেকেই কষ্ট দেয়, নিজেরই স্বাস্থ্য নষ্ট করে । তাতে আর কার কী এসে গেল! নাকি একসঙ্গে এক ঘরে বাস করতে গেলে কুড়িয়ে ছড়িয়ে না থাকলে কারোর সহানুভূতি আকর্ষণ করা যায় না। কমলেন্দুকে মানুষ করতে সুধা সেনের মা যে-পরিমাণ অর্থ আর সম্পত্তি ব্যয় করেছেন, সেট? থাকলে আজ বোঁধ হয় সুধা সেন অন্যরকম হত । বোধ হয় স্ধ। সেন পেট ভরে খেত । বোধ হয় তার স্বাস্থ্য এমন নিজীঁব হত না। হয়ত সুধা সেনকে বি. এ. পাস করতেও হত না, চাকরি করতেও হত না। বিয়ে করে দেশের আর পাঁচজন মেয়ের মতো সংসার পাততে পারতো । পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বোডিং-এ বড্ড কড়াকড়ি । দোতলার ভিজিটার্স রূমে অনেক টেবিল, চেয়ার, বোঞ্চ। সেখানেই বসলাম দু'জনে । ঘরে আরো অনেক ছেলেমেয়ে গল্প করছে। স্পাি- কন্ঠাপক্ষ ১২ ন্টেণ্ডেট-এর নাকি অন্ুুখ, তিনি নিচে নামবেন না। আমি বসে রইলাম, স্থধা সেনই ওপরে তার সঙ্গে দেখ! করতে গেল। সুধা সেন খানিক পরে আবার সেই নিবিকার মুখ নিয়েই ফিরে এল । বললে, 'হল না চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। তার পেছনে পেছনে চলতে লাগলাম আবার । তারপর? তারপর কী? ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম । কাট ঘুরে একেবারে তিনটের ঘরে চলে এসেছে । এখনও কিন্তু সুধা সেনের খিদে পাবে না। অন্তত খাবার কথার উল্লেখ না করলে আর খাবার কথা৷ বলবে না সুধা সেন। ট্রাম-রাস্তায় এসে পড়েছি । আমার যেন আর নড়তে ইচ্ছে করছে না। সুধা সেন কিন্তু অক্লান্ত । মনে হল এখনও গভীর রাত্রি পর্যন্ত এমনি অনির্দিঃ ঘোরাঘুরি চালিয়ে যেতে পারবে। সুধা! সেনের দিকে চাইলাম । বললাম, তারপর ? সুধা সেনও আমার দিঁকে চেয়ে বললে, তারপর কী বলুন ?' তারপর যেন আর সত্যিই কিছু করবার নেই। যেন এখানেই এসে পূর্ণচ্ছেদে:পরিসমাপ্তি। আর চলবে না চাকা। এখানেই নামতে হবে শেষবারের মতো । এরপর শুধু ধূদর হতাঁশ। ! বৌদি বলেছিল, “ভারি ছট্ফটে মেয়ে, আর বড্ড একগ য়ে, যা নিয়ে লাগবে তা শেষ পর্যন্ত করে ছাড়বে, খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, অদ্ভুত গে! ওর !' শেব পর্যন্ত বললাম, “আবস্ুন, কিছু খেয়ে নেওয়। যাক ।, আপত্তি করলে ন' সুধা সেন। বললে, চলুন ।' একটা ভালে রেস্তের1 দেখে ঢোক! হল। ঘরময় লোক। আধা সেনকে নিয়ে ঢুকতেই চারিদিক থেকে দৃষ্টি পড়লো! আমাদের ওপর । কোনও পরিচিত লোকের দৃষ্টিকেই ভয় ছিল, নইলে আর অন্ভুবিধে কিসের । নুধা সেনকে নিয়ে যে-কোনো লোকের বিব্রত হবারই কথা । সুধা সেনের চেহারাই এমন, তার ওপর নজর ন। পড়ে উপায় নেই । ১৩ কন্তাপক্ষ কোনো রকমে সুধা সেনকে নিয়ে একটা কেবিনের মধ্যে ঢুকেছি। পর্দাট। অর্ধেক টেনে দিলাম । কোনো মেয়ে যে একজন পুরুষের সামনে অমন গোগ্রাসে খেতে পারে, স্থধা সেনকে সেদিন কেবিনের মধ্যে খেতে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম ন! সত্যি। নাকি সকালে ঘুম থেকে ওঠা পর্ধন্ত কিছুই খায়নি । হয়তো হাতে পয়সা নেই। সেই কোন্‌ সকালে বড়দার বাড়ি থেকে বৌদি জাগবার আগেই বেরিয়ে এসেছে, তারপর দোকান থেকে কি আর এক কাপ চা-ও খায়নি । আমাদের বাঁড়িতে যখন সুধা সেন এল তখন সাড়ে দশট। সকাল । তারপর এখন তিনটে বিকেল । সত্যি সুধা সেনের ক্ষমতা আছে। স্থ্ধা সেন নিজের মনেই খাচ্ছে, আর আমি অপাঙ্গে তাই দেখছি। ছুভিক্ষের সময় ক্ষুধার্ত মুমূর্ধ ভিখিরির আহার দেখেছি, সে এক রকম । কিন্তু এই সুধা! সেনের খাওয়া! বি. এ. পাস, প্রাইভেটে এম. এ. দেবে, শিক্ষিত! মেয়ের এই আহার যেমন কদর্ধ তেমনি কুৎসিত । সমস্ত মন আমার বিষাক্ত হয়ে উঠলো । তিন টাক বিলের দাম চুকিয়ে দিলাম নিঃশবে | বললাম, “উঠুন ।+ আরো বোধ হয় খেতে পারতো সুধা সেন। সুধা সেন যেন আজ সাত দিনের খাওয়া একদিনে খাবে বলে মনস্থ করেছে । রাস্তায় বেরিয়েই কিন্তু করুণা হল। পরিমাণে যে খুব বেশি খেয়েছে সুধা সেন, তা নয়, কিন্তু তার খাওয়ার ভঙ্গিটাই যেন বড় বিশ্রী লেগেছিল সেদিন। যেন খানিকট। শক্তি পেয়েছে সুধা সেন। বললে, চলুন, একবার গোয়া- বাগানে শেষ চেষ্টা করে দেখি ।, মোহিতের দেওয়া ঠিকানাটার কথা ভূলে গিয়েছিলাম। নোট-বুকে লেখা ছিল। এবার শেষ চেষ্টা। হাতে আর আশ্রয়ের সন্ধান নেই। এবারেও যদি ফিরে আসতে হয় তাহলে নিরুপায় । স্ুধা সেনকে বললাম, ট্রামে উঠুন তাহলে-_ কলেজ স্টশটের মোড় থেকে গোয়াবাগাঁন দশ মিনিটের রাস্তা। ট্রামে খুব ভিড়। কিন্তু কেন জানি ন। লোকজন সুধা সেনকে দেখেই রাস্তা করে কণ্তাপক্ষ ১৪ দিলে। লেডীজ. সীট ভি ছিল। একজন পুরুষ যাত্রী সুধা সেনের জন্যে জায়গাট। ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়ালেন। স্মুধা সেনের কৃশ শরীর দেখে দয় হওয়াই স্বাভাবিক । মনে হল, ভিড়ের মধ্যে সুধা সেনকে ছেড়ে দিয়ে যাৰ নাকি পালিয়ে । ন! হয় খুঁজে মরুক নিজের আশ্রয়। গোটাকতক পয়স! খরচ হোক স্ধা সেনের। তারপর, লেখাপড়। জানা মেয়ে রাস্তায় আর রাত কাটাতে হবে না। রাত্রি বাঁরোট। পর্ষস্ত কোনে রকমে রাস্তায় কাটিয়ে তারপর আশ্রয় নিক গিয়ে বড়দাঁর বাড়িতে নিত্যকার মতো। সুধা সেনের বড়দা লোক ভালো, তিনি ঠিক রাত বারোটার সময় স্ত্রীর অজ্ঞাতে দরজার খিল খুলে দেবেন । আমার কিসের মাথাব্যথা ! আমার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে আমি কেন মিছেমিছি ঘুরে বেড়াচ্ছি সুধা সেনের পেছনে পেছনে । আমার কিসের দায়! সুধা! সেন আমার কে! অমন কত অসংখ্য মেয়ে কলকাতার রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে আছে । আর অভাব? অভাব কার নেই! বি. এ. পাশ করেছে, প্রাইভেটে এম. এ, দেবে, তারপর হয়তো একদিন টি-বি হবে__হয়তো তখন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে কেউ দয়া করে। একট। ফ্রি-বেড যোগাড় হলেও হতে পারে । তারপর কে মনে রাখবে সুধা মেনের কথা । দেশে মা হয়তো। মনিঅর্ডারের আশায় মাসের পর মাস বসে থাকবে-_ভাই-এর স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে যাবে টাকার অভাবে। বড়দাকে মাঝরাতে উঠে আর দরজ। খুলে দিতে হবে না। ছোড়দাকে বিরক্ত করতে আসবে না কেউ।*-" স্বধা সেন নিজেই উঠে এসেছে । “নেমে পড়,ন, গোয়াবাগানে এসে পড়েছি যে_+ গলির ভেতরে বাড়িটা খুঁজে নিতে একটু কষ্ট হল। তা হোক, পাওয়! গেল তা-ই ভালো । একটা আধপুরোনো বাড়ির অর্ধাংশ। সেই অর্ধাংশ নিয়েই মেয়েদের বোডিং। রাস্তার ওপর দাড়িয়ে বাড়িটার প্রবেশপথের একট। নিশান! খু জছিলাম। নুধাদি!, পেছন ফিরে দেখি একট। ছোট ছেলে সুধা সেনের সামনে দাড়িয়ে আছে। ১৫ কন্ঠাপক্ষ “কিরে বিলুঃ তুই ! এখানে কোথায় ? ছোট হাফ প্যান্ট পর! ছেলেট!1 চেনে সুধা সেনকে । আমার কাছে যেন হঠাৎ স্বধা সেনের মর্ধাদা বেড়ে গেল। নুধা সেনকে কেউ চিনবে, কেউ তাকে চিনে নাম ধরে ডাকবে, তা সে হোক না ছোট ছেলে-__এটা যেন আমার কাছে অবিশ্বান্ত ছিল। তাহলে নিতান্ত অসহায় নয় সুধা সেন। তারও এই কলকাতা শহরে পরিচয়ের ন্বর্ণসূত্র আছে । সেই সুত্র ধরে সে আশ্রয়ের সপ্তম স্বর্গে পৌছতেও পারে ! “তোরা কবে এলি রে কলকাতায় ? “এই তো। সাতর্দিন এসেছি মামার বাড়িতে । আমি কিন্তু তোমায় দেখেই চিনতে পেরেছি স্ুধাদি'__বিলু বললে। “মা কেমন আছে রে? তারপর আবগ্তক-অনাবশ্যক অনেক কথা । সুধা সেন যেন হঠাৎ খুব খুশি হয়ে উঠলো । সুধা সেনের দেশের ছেলে । অনেকদিন পরে দেখ। হয়ে গেছে । আমি তে? আকাশের চাদ হাতে পেলাম । এখন কোনো রকমে সুধা সেনকে ছোলেটির হাতে গছিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারি। সুধা সেনের সঙ্গে পরিচয় থাকার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারি। সুধা সেন বললে, “তুই দাড়া বিলু, এখানে যদি ঘর না! পাই, তাহলে তোর মামার বাড়িতেই উঠবো একটা রাত্তিরের জন্যে |, যাক, এতক্ষণে যেন আশার একটা ক্ষীণতম শ্বত্র পাওয়া গেল। তারপর ম্ধা সেনকে নিয়ে বোডিং-এর গলির ভেতর ঢুকলাম । গলির পেছন দিকে ছোট দরজ1। সুধা সেনই সামনে এগিয়ে গেল । “আপনাদের বোডিং-এর স্থপারিন্টেণ্ডে্ট-এর সঙ্গে দেখা করতে পারি ৮ “তিনি তো৷ এখন নেই। কী বলবেন আমাকে বলুন ।, বেশ বয়সী মহিলা! একজন। বিধবার বেশ। সরু চুলপাড় ধুতি পরনে । মাথায় একটু ঘোমট1। আমি এগিয়ে গেলাম। বুবিয়ে বললাম সব। বললাম সুধা সেনের সত্যিকারের সবিস্তার দুর্দশার কাহিনী । কন্ঠাপক্ষ ১৬ আশ্রয় এখানে না পেলে আজ রাত্রে কোথায় কাটাতে হবে, তার কোনে। ঠিকই নেই। সুধা! সেনের কৃশ চেহারা দেখে মহিলাটির যেটুকু সন্দেহ ছিল, তাও যেন দূর হয়ে গেল। সুধা সেন বিধবা নয়-_কুমারী, তবু মহিলাটি বোধ হয় মনে হল--বিধবার চেয়েও সহায়হীন সে। যে সুধা সেনের কৃশ, রুগ্ন চেহারা আমার মনে বিতৃষ্ণার উদ্রেক করেছে, তাই-ই মহিলাটির মনে সহানুভূতির স্থষ্টি করতে পেরেছে যেন। মহিলাটি বললেন, “এখন তো! আমাদের কোনে। সীট খালি নেই, তবে কয়েকদিন পরেই খালি হবে'**) তাঁরপর খানিক থেমে আবার বললেন, “তবে নেহাত যদি কোথাও থাকবার জায়গা না থাকে, তাহন্ভল আমার সঙ্গে এক ঘরে থাকতে দিতে পারি কয়েকদিনের জন্যে |; একট নিশ্চিন্ত আরামের নিশ্বাস ত্যাগ করলাম । মনে হল ঘাড় থেকে যেন একটা ভারি বোঝা নেমে গেল । সুধা সেনও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে । বিছানা সঙ্গে আনেনি সুধা সেন। তা সে কাল সকালে আনলেই চলবে । সুযুটকেসট। ছাত্রের বাড়িতে পড়ে আছে, সেটাও কাল সকালে আনলেই চলবে। ইতিমধ্যে একটা মাদুর ব। ছেঁড়। শতরঞ্জি কি আজকের রাতটার জন্যে কারোর কাছে ধার পাওয়া যাবে না? বালিশ সুধা সেনের দরকার হয় না। মাথার ওপর একট? ছাদ, চারদিকে চাঁরটে দেওয়াল, আর ছেড়া একট মাছুর-_-এর বেশি কোনে দিন কিছু চায়নি স্থুধা সেন। সুধা সেনকে সেইখানে রেখে আমি আর সুধা সেনদের দেশের সেই ছেলেটি চলে এলাম। গলির বাইরে এসে একট! মুক্তির নিশ্বাস পড়লো। সারা দিনটার এমন অপব্যয় আর কখনও করিনি এর আগে । সুধা সেন আমার কাধ থেকে নামলো! শেষ পর্ষস্ত সেই-ই আমার সৌভাগ্য ! শুধু এইটুকু ঘটনা হলে এ গল্প লেখবার প্রয়োজন হত ন1। কিন্তু ঘটনাচক্রে যে বিপরীত চরিত্রের আর একটি মেয়েকে আর একদিন অন্য পটভূমিকায় দেখতে পাব, সে কথা কি আমিই জানতুম | ১৭ কন্তাপক্ষ সুবোধ এসেছিল কলকাতায় । নতুন-দিল্লীর বড় কন্ট্রাক্টার সুবোধ রায় আবার বহুদ্দিন পরে কলকাতায় এল। স্থধা সেনকে ভুলেই গিয়েছিলাম । মনে রাখবার মতো মেয়ে তো সুধা সেন নয়। বহুদিন পরে বৌদিকে জিগ্যেস করেছিলাম, “তোমাদের সুধা সেনের খবর কি কৌদি ? বৌদি বলেছিল, “তোমায় তে। বলেছি, সে চাকরি ছেড়ে দ্রিয়ে ধানবাদে চলে গেছে, সেখানে পাঁচ টাকা মাইনে বেশি পাবে নাকি । আমরা অফিসের সব মেয়েরা অনেক করে বললাম, কিছুতেই থাকলে না। বললে,__-এ মাইনেতে আর কুলোতে পারছি নে।; স্বধা সেনকে অনেক কষ্টে বাস। যোগ|ড় করে দিয়েছিলাম, ওইটুকুই: শুধু মনে ছিল। কিন্ত পাঁচ টাক বেশি মাইনের লোভে কলকাতার বাস৷ সে ত্যাগ করবে, তা আগে জানলে সেদিন অত কষ্ট স্বীকার করতাম কিন' সন্দেহ । কিন্ত আমার বন্ধু স্থুবোধ রায়ের ও-সব সমস্তা নেই। বছরের মধ্যে বার দুই-তিন কলকাতায় আসতে হয় সুবোধ রায়কে এবং বরাবর কলকাতার নাম-কর! হোটেলেই এসে ওঠে । সেখানে রুমের যত অভাবই হোক, অবোধ রায়ের জন্যে সবচেয়ে ভালো ঘরটাই ব্যবস্থা কর! হয়-_ তেতলার সবচেয়ে দামী দক্ষিণমুখো একট ঘর। আলো হাঁওয়। প্রচুর । ঘরের দক্ষিণযুখে। ব্যাল্কনি থেকে সামনের পার্কট। দেখা যায়; হু হু করে হাওয়া আসে দিন-রাত । ছুটে ফ্যান। বাথরুম পাশেই । বাথরুমে গরম কলের জলের ব্যবস্থা । শাওয়ার বাথ । মোজেয়িক করা মেঝে । ছুটে। চাঁকর অনবরত ত্যাটেণ্ করে। হোটেলের সর্বোত্তম স্ুখস্থুবিধা ওই ঘরটাতেই আছে। তার জন্তে চার্জ যা! করা হয়, কন্ট্রাক্টার স্থবোধ রায়ের পক্ষে তা কিছুই না। ও-ঘরটার বিশেষ দরের জন্যে ও-টা এমনিতে সাধারণত খালি পড়েই থাকে । নিয়মমতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একেবারে তেতলায় চলে গেছি। ছুটির দ্রিন দেখেই গেছি। কিন্তু নির্দিষ্ট ঘরটিতে এসে হঠাৎ বাধ। পেতে হল। কন্ঠাপক্ষ--২ কন্তাপক্ষ ১৮ “কাকে চাই, সাব ?_একট। চাপরাসী উঠে দাড়াল । 'স্ুবোধ রায়। দিল্লী থেকে এসেছেন।+ “তিনি দোতলার কামরায় আছেন, ওখেনে খোঁজ করুন।” চাঁপরাসীট। বললে। 'এখানে তবে কে আছেন ? আবার প্রশ্ন করলাম। 'মেম সাহেব ।' মেম সাহেব! যেন বিতাড়িত, অপমানিত বোধ করলুম । মনে হল-_- স্রবোধ রায়কে তার চির-অধিকৃত ঘর থেকে যেন গলাধাক। দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে। নিচে গিয়েই দেখা হল। বললাম, “একি? কী হল? এ ঘরে? সুবোধ রায়ের মুখের চেহার। দেখে বুঝলাম সে-ও কম বিরক্ত হয়নি । স্ববোধ বললে, “কে একটা খুব বড়লোক মেয়ে এসেছে--ওই ঘরেই আছে। “বাঙালী নাকি? জিগ্যেস করলাম । হ্যা, বাঙালীই তো শুনেছি । ছু'হাতে পয়সা খরচ করছে । চাঁকর- বাকর, চাপরাসী, আয়া সকলকে বকশিশ দিয়ে এরই মধ্যে হাত করে ফেলেছে । ভালো ভালো ডিশ. যা-কিছু সব অর্ডার দিচ্ছে । সকালে ব্রেক- ফাস্টে ডিম একদিন বাসি ছিল বলে কমপ্লেন করেছে । শুধু তাই নয়, ব্রেক- ফাস্ট লাঞ্চ ডিনার কোন কিছুতে একটুকু ত্রুটি ঘটলে নাকি অনর্থ ঘটাবে মেয়েটি । ছু'চারজনের ইতিমধ্যে ফাইনও হয়ে গেছে । ম্যানেজার থেকে সুরু করে জমাদার পর্ষ্ত সবাই সন্ত্রস্ত । এতটুকু ক্রটি যাতে না! ঘটে সেই দিকেই সকলের লক্ষ্য । গেটে দারোয়ান একদিন সেলাম করতে ভুলে গিয়েছিল বলে শাস্তিও নাকি হয়েছে তার। এখন হোটেলের মালিকের কানে।যাতে না যায় সেই চেষ্টাই করছে ম্যানেজার । নইলে যে-সব ত্রুটি এ-পর্ষস্ত ঘটে গেছে তা তার কানে গেলে ম্যানেজ রের চাকরি নিয়ে টানাটানি পর্ষস্ত হতে পারে।, কেউ কেউ বলছে, “কে'নো এক দেশীয় রাজ্যের ছোটরানী লুকিয়ে এসে এখানে রয়েছে । | ১৯ কন্ঠাপক্ষ স্ুধোধ বললে, “ময়েটাকে দেখিনি কখনও | বিয়ে হয়েছে কি হয়নি জানিনে__তবে খায় খুব--সকালবেল! ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পাই সি'ড়ি দিয়ে ওয়েটারর! ডিশের পর ডিশ. নিয়ে যাচ্ছে । ডিনারেও তিনটে কোর্সে কুলোয় না ।? অনেকদিন আগেকার সুধা সেনকে মনে পড়লো । সুধা সেন খেত না। খাবার জায়গাও ছিল না বটে, তা ছাড়। পয়সাও ছিল না সুধা সেনের । তারপর সেই রেস্তোরণর কেবিনে ঢুকে গোগ্রাসে খাওয়া ! সেদিন সুধা সেনের খাওয়। বড় বিশ্রী লেগেছিল মনে আছে । দেখলাম হোটেলের চাকর-বাকররা যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বেশি গোলমাল না হয় কোথাও । ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত মিড়ি ধোয়ামোছ _ পরিষ্কার ঝকৃঝক তকৃতক্‌ করছে । কয়েকটা পাম, অফ্িড আর ফুল- গাছের টব দিয়ে সাজিয়েছে সার বাড়িটা । কে এসেছে যে তার জন্তে এত ব্যস্ততা, এত আয়োজন ! সুবোধ রায়ের সঙ্গে দেখ। করতে ছৃ*চারদিন গিয়োছ, কিন্তু সেইদ্দিনই প্রথম দেখা হয়ে গেল। দেখে অবাক্‌ হলাম । দারার কাটা মুণ্ড দেখে সজাহানও এত বিস্মিত হয়েছিলেন কিন। সন্দেহ ! নুধা সেন ! পেছনে পেছনে ছুটে ওয়েটার চলেছে স্বধা সেনের । সিঁড়ির আশে- পাশে যারা ছিল তার উঠে দাড়িয়ে সেলাম করতে ব্যস্ত ! এক নিমেষে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছি । বিস্ময়ের আর অবধি ছিল না আমার । সেই সুধা সেন! সেই কৃশ মেয়ে ! উপোস করে না- খেয়ে-খেয়ে পয়সা বাঁচায়! সারা শহর খুঁজে বেড়ায় একটু আশ্রয়ের জন্যে । বড়দার বাড়িতে রাত বারোটার পর গিয়ে লুকিয়ে শুয়ে পড়ে, আর স্নান করতে যায় ছোড়দার মেসবাড়িতে। একবার মনে হল ভুল দেখছি নাতো! সমস্ত যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে গোলমাল হয়ে গেল। পরদিনই বৌদির বাড়িতে গেলাম । এ-কথা সে-কথার পর বললাম,“তোমার সেই সুধ। সেনের খবরকি বৌদি? কণ্ঠাপক্ষ ২৬ বৌদি বললে, “হঠাৎ সুধা সেনের কথা জিগ্যেস করছে৷ যে % বললাম, “না, এমনি আজ ট্রামে আধা সেনের মতে। একটা মেয়েকে দেখলাম কিনা, সেবার বলেছিলে তো যে ধানবাদে গেছে সুধা সেন । পশ্চিমে গিয়ে মোটা-সোটা হল ? খবর পেয়েছ কিছু ? বৌদি খবর দিতে পারলে না। বুঝলাম সুধা সেন কাউকেই খবর দেয়নি কিছু। দিন সাঁত-আট পরে একদিন সন্ধ্যেবেলা৷ সেই হোটেলে ঢুকছি এমন সময়ে সামনেই দেখি সুধা সেন। কিন্তু আমি এড়িয়ে বাবার আগেই সুধা সেন আমায় দেখে ফেলেছে । আমাকে দেখে সুধা সেন যেন আকাশ থেকে পড়লো । চারিদিকে চাকর-বাকর চাপরাসীর ভিড় । সবাই বকশিশ পাবার জন্যে ব্যস্ত । ন্ুধা সেনকে দেখে মনে হল যেন সে হোটেল ছেড়ে আজ চলে যাচ্ছে। স্্যটকেস বিছান! বাক্স সব সামনে নামিয়েছে। ট্যাক্সি হাজির । সুধা সেন সকলকে বকশিশ দিয়ে একপাশে সরে এসে চুপি চুপি বললে, 'আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ভালোই হল। আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ একট দরকার আছে ।? তারপর সুধা সেন মালপত্র ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে বললে; 'আস্মন ।? স্থধা সেন গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলো । আমিও পেছন পেছন গিয়ে উঠলাম । কে জানে কোথায় আবার যাবে সুধা সেন ! বৌদির কথাট। মনে পড়লে! । সুধা সেন সত্যিই কি ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছে, না, যুদ্ধের কল্যাণে কোনো অজ্ঞাত কারণে অনেক টাকা তার হাতে এসে পড়েছে, কে বলতে পারে ! ট্যাক্সি চলতে স্থুর করতেই সুধা সেন আমার দিকে চেয়ে বললে, “আমাকে আপনি বাঁচান |, আমি বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চাইলাম । কিছু বুঝতে পারলাম ন। কী সেচাইছে। ২১ কন্ঠাপক্ষ স্বধা সেন আবার বললে, “একটা রাতের জন্তে আমার একট! থাকবার ব্যবস্থা করে দিন, আমি একেবারে নিরাশ্রয় ।' তবুও যেন কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তবে এই এশ্বর্ষ, এই বকশিশ দেওয়ার বহর, এই হোটেলের সবচেয়ে সের! ঘর নিয়ে থাকা, এই ত্রেক- ফাস্ট লাঞ্চ ডিনার"*' সুধা সেন বললে, “আপনাকে আমি সব খুলেই বলছি, আমায় বিশ্বাস করুন। আমার কাছে আর একটা টাকাও নেই। এতদিন না-খেয়ে- খেয়ে যা কিছু টাক। জমিয়েছিলাম, সব নিঃশেষ হয়ে গেছে । আমি আবার আজ নিরাশ্রয়। এই ট্যাক্সি ভাড়া করেছি বটে, কিন্ত কোথায় যাব কিছুরই ঠিক নেই ।” আমার মাথায় যেন ব্ভ্রাঘাত হয়েছে। আমি প্রাণশৃন্ত দৃষ্টি দিয়ে সুধা সেনের দিকে চেয়ে রয়েছি । আমি কি আবার সেই সুধা সেনের জন্যে আশ্রয় খুজতে চলেছি! আবার সেই হোস্টেল, মেস আর বোডিং-এর দরজায় দরজায় বে-হিসেবী সুধা সেনের জন্যে ধর্ণ। দিতে চলেছি ! তারপর এই ট্যাকসি-ভাড়া, তা-ও কি আবার আমাকেই দিতে হবে ! সুধা সেন তার কাঠির মত আঙুল দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরলে, 'আপনাকে একট জায়গা খুঁজে দিতেই হবে আমার জন্তে। আপনি যে সেই বলেছিলেন আপনার কোন্‌ এক বন্ধু আছে--চলুন না এখন তার ওখানে যদি থাকতে দেয় ।” | সেদিন বলেছিলাম বটে। কিন্তু সুখেন্দুর বাড়ি তো এখানে নয়। বেলগাছিয়ার একেবারে শেষ প্রান্তে সে-বাড়ি । তা ছাড়া তার এক দিদির একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে আসবার কথা ছিল। যদি তারা এসে থাকে, তাহলে কি আর জায়গা পাওয়া যাবে সেখানে ! রাগে ছুঃখে ধিককারে আমার সমস্ত মন বিষিয়ে উঠলো । সুধ! সেনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, আচ্ছা চলুন, দেখি, ট্যাক্সি চললো।। হাওয়ার মতে উড়িয়ে চললো! । সুধা সেনের চুলগুলো! উড়ে পড়ছে তার কালে মুখের ওপর । কেজানে কোথায় এ-যাত্রার শেষ ! কন্তাপক্ষ ২২ শেষ পর্যন্ত আশ্রয় আজ মিলবে কিন! ঠিক কী ! কলেজ স্টাট, কর্ণওয়ালিশ স্টীট পেরিয়ে ভান দিকে চলল ট্যাক্সি। বেলগাছিয়ার পুল পেরিয়ে আরো ভেতরে গিয়ে গাড়ি দাড়াল এক গলির সামনে । গাড়ি থেকে নেমে বললাম, “আপনি বসুন, আমি দেখে আসছি ।, অন্ধকার গলি। গলির শেষ প্রান্তে বাড়িটা । রাত তখন বেশি হয়নি । নির্দিষ্ট বাঁড়িটার সামনে আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে ছোট ছেলেমেয়েদের কলরোল কানে এলো । এ বাড়িতে তো ছোট ছেলেমেয়েদের বালাই ছিল না। তবে কি সুখেন্বুর দিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে নাকি ! ডাকবে কিনা ভাবছি । যদি স্ধা সেনের উপকার হয়। কিন্তু মনট? আমার বিষিয়ে উঠলো । বে-হিসেবী সুধা সেনের পরিচয় তো আমি ভালো করেই পেয়েছি । বন্ধুকে আর ডাকলাম না। গলির এ প্রান্তে ট্যাক্সির কাছে আর ফিরেও এলাম না। এ প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পড়লাম আর একটা সমান্তরাল বড় রাস্তায়। তারপর কোনে। দিকে দৃষ্টিপাত না৷ করে ওদিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে উঠে পড়লাম ধর্মতলার ট্রামে। তারপর চলন্ত ট্রামের জনবহুল একটি কোণে নিজেকে আড়ালে রেখে নিশ্চিন্তে দাড়িয়ে রইলাম। থাক্‌ স্ুধ! সেন ট্যাক্সিতে বসে। ট্যাক্সির ভাড়া যদি না৷ দিতে পারে, তাতে আমার কি আসে যায়! সুধা সেন প্রতীক্ষমাণ ট্যাক্সিতে বসে মুহুর্তের পদধ্বনি শুনতে থাক্‌, আমি ততক্ষণ বাড়িতে পৌছে গিয়ে নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে নিবিড় ঘুমের মধ্যে গা গড়িয়ে দেব। আমার এত কিসের ভাবনা সুধা সেনের জন্যে ! কয়েক দিন পরে বৌদিকে সুধা সেনের কথা জিগ্যেস করতেই বৌদি বললে,_-একদিন নাঁকি হঠাৎ রাত বারোটার সময় স্বধা সেন ট্যাক্সি করে বৌদির বাড়িতে এসে হাজির । সে রাতটা বৌদির বাড়ির সি'ড়ির ঘরের ভিতর কাটিয়ে সকালবেলাই চলে গেছে আবার-_-কোথায় চলে গেছে বলে যায়নি । স্ুধ। সেনের চাকরিও চলে গেছে অফিস থেকে । সুধা সেন! ভাবলেই সুধা সেনের চেহারাটার কথ। মনে পড়ে । সেই কৃশ স্বাস্থ্যহীন চেহারা, নিশ্প্রভ দৃষ্টি, হয়তো কলকাতা শহরের জনতার ২৩ কন্তাঁপক্ষ ভিড়ে মিশে গেছে আবার | নয়তে। ফিরে চলে গেছে দেশে মা"র নিশ্চিন্ত- নির্ভর আশ্রয়ের নীড়ে । শহরের অশান্ত প্রতিযোগিতার ক্লান্তি থেকে অনেক দূরে-যেখানে অবারিত মাঠ, দিগন্ত-বিসারী আকাশ, আর স্নেহকোমল ছাঁয়া-নিবিড় নীড় । চারটে দেয়াল আর একট। ছাদের আবরণে সেখানে শরীর কূশ আর আয়ুক্ষীণ হয়ে আসে না । সুধা সেন সত্যি সত্যি আবার সেইখানেই ফিরে গেছে কিন! কে বলতে পারে ! আমার জীবনে স্থধ! সেন তারপর চিরকালের মত হারিয়েই গিয়েছিল মনে করেহিলাম। মনে করেছিলাম ও-পরিচ্ছেদের বুঝি ওখানেই পূর্ণচ্ছেদ হয়েছিল । গল্পটা! সোনাদিকে বলেছিলাম । সোনাদি বললে, ন্সুধা সেনকে নিয়ে উপন্তাস হবে না তোর, ও তো এক চোখে দেখা, আর একটা দিক ও আছে সুধা সেনের, সেটা তুই দেখতে পাসনি-_ কিন্ত হারিয়ে সেদিন যায়নি সুধা সেন। মনে আছে তার কত বছর পরে সুধা সেন হঠাৎ একটা চিঠি দিয়েছিল । লিখেছিল, আঁসছে সতরোই ফাল্গুন আমার বিয়ে, আপনার কিন্তু আসা চাই-ই-_+ চিঠিটা পড়ে কিছুকালের জন্যে আমি যেন হতবাক্‌ হয়ে গিয়েছিলাম । এর চেয়ে আমাকে ধরে চাবুক মারলেও যেন আমি এত স্তস্তিত হতাম ন1। এমন করে আমার জীবনে আর কোনও মেয়ে আমাকে এমন অপমান করেনি, এইটুকুই শুধু আজ মনে আছে। মনে আছে তারপরে একট। গল্প সোনাদিকে না-শুনিয়ে একেবারে লিখেই ফেলেছিলাম । আমার বাড়ির পাশের অলকা পাল। অলক! পালকে দেখতাম কেবল টিউশানি করতে আর স্কুলের চাকরি করতে । দেখে মায়া হত আমার । মনে হত অলক পালের জীবনে কোনো! দিন কোনো আগন্তক ভূল করেও বুঝি আসতে পারে না। নেহাত সুধা সেন- কন্তাপক্ষ রঃ এর .মতোই বুঝি সে সংসারে একেবারে নিরর্থক । কিন্তু সেই অলকা! পালের বাসার সামনেও দেখেছিলাম একদিন একট। মস্ত গাড়ি দাড়িয়ে আছে। আর ভেতরে বসে আছে আমার দাঁদার বয়সী একটা ছেলে । কেমন যেন অবাক্‌ হয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু বোধ হয় ছু”দিনই দেখেছিলাম গাড়িটা । তারপর আর 'কোনো দিন কোনে! রহস্য আমার মনে জাগেনি অলকা৷ পালকে নিয়ে । স্বধা মেন-এর জীবনে যৌবন এসেছিল কিনা কে জানে। অন্তত আমার চোখে তা কোনোদিন ধরা পড়েনি । কিন্ত অলকা' পালের জীবনে হয়তে। এসেছিল । এবং তা-ও বুঝি কেবল এক মুহূর্তের জন্যে! তাই-ই বা ক'জনের আসে ! গল্পটা যেমন লিখেছিলাম তেমনিই বলে যাই-_ রোজ রাত্রে যে শব্দটায় অলকার ঘুম ভেঙে যায়--সেই শব্দটা সেদিনও স্থরু হল। অলক বিছান। ছেড়ে উঠলো।। ঘুম ঘি তার আবার আসে, তবে সে তার সৌভাগ্যই বলতে হবে। এ পাড়ায় এ-বাডডিট। নতুন ভাড়। নেওয়া হয়েছে । চারপাশের অধিবাসীদের সঙ্গে এখনও ভালে। করে পরিচয় হয়নি। অপরিচয়ের আবরণ ঠেলে তার কেউ আত্মপ্রকাশ করেনি আজে। কিন্ত ছাদে উঠলে দেখ। যায় পাঁশের বাড়ির একতলার রোয়াকে বসে বউরা সংসারের কাজে ব্যস্ত-_-অলকাকে দেখে তারা ঘোমট। বড় করে টেনে দেয় । স্বাধীন মেয়েদের ওরা পুরুষেরই সামিল বলে ধরে নেয় বোধ হয়। শীতের রাত। খুব বেশি শীত নয়, তবু গায়ে চাদর ঢাক দিতে হয়। জানলাট1! খোল ছিল। খোল জানলার ওপাশে রাস্তার পারের চিলে- কোঠা, তার ওপর আকাশ-_ফিকে নীল । কতদিন রাত জেগে অলকা! নীল ভোর দেখেছে । কিন্তু শব্দট1 কিসের ! অলক জানলার কাছে এল । পাশের বাড়িতে আওয়াজটা হচ্ছে মনে হল। স্টোভের আওয়াজ ; এত রাত্রে স্টোভ জ্বালবে কে ? কারোর অসুখ ? | “অলক !; অলকা চমূকে উঠেছে । নিঃশবে গ্রীতি জেগেছে । অলকা বললে, "ঘুম ভেঙ্গে গেল তোর ? ২৫ কন্তাপক্ষ কাল কখন এলি ? কাল রাত্রে অলকার ফিরতে অনেক দেরি হয়েছিল । সেই টালিগঞ্জ". ছাড়তে কি চায়! ক্লাস ফাইভের মেয়ে- লেখাপড়ায় অত ঝোৌক কে জানে। তারপর পড়িয়ে আসার পর ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ নিয়ে যখন অলক ফিরে এসেছিল, তখন এখানকার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে । বিছানার পাশে মেঝেতে খাবার ঢাকা ছিল। শীতকালে ঠাণ্ডা ভাত খেতে অলকাঁর কষ্টই হয় একটু । মা দেশ থেকে চিঠি লিখেছিল স্বাস্থ্যের ওপর নজর রাখতে । অলক আবার হাঁসলে-_ স্বাস্থ্য দিয়ে তার কী হবে! যে-স্বাস্থ্য নিজেরই কোনে কাজে লাগলো না, তা দিয়ে কী কাজ হবে তার ! আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছে । নীল ভোর। আজ কুয়াশা কম। অলক গায়ের ওপর একট। আলোয়ান চাপিয়ে দিলে । এখনি আরন্ত হবে দিনের কাজ। ছুটতে হবে পড়াতে । পড়িয়ে এসে স্কুলে যেতে হবে। স্কুল সেই অনেক দূরে--হাটতে হাটতে প্রাণান্ত। প্রাণান্তকর পরিশ্রম না করলে কি চলে! ম। দেশ থেকে চিঠি লিখেছিল, স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে । অলক আবার হাসলে । তার আবার স্বাস্থ্য । প্লীতি বললে, 'কাল তোকে কে খুঁজতে এসেছিল, জানিস অলক ? কেরে? অলকার বিম্ময়ের আর সীম। নেই। পরিচিত আর স্বল্প পরিচিতের ভিড় ঠেলে অলকার দৃষ্টি অনেকদূর প্রসারিত হল-_-কে তাকে ডাকতে এসেছিল! গীতি বললে, “তার নাম করলে আবার-” অলকা৷ অবাক হল-_-এ-বাড়ির ঠিকানা তে। কেউ এখনো জানে না! “কী রকম চেহার। রে ? “চেহারা কি আমি দেখেছি ? অন্ধকারে দাড়িয়েছিল। আজ সকালে আবার আসবে বলেছে । রাস্তায় গাড়ি দাড়িয়েছিল--বিরাট একটা মোটর, মোটরে সে একলা শুধু-- অলক! ব্ম্মিয়ে আরো অবাঁক্‌। তার কাছে কে আসবে গাড়ি চালিয়ে ! জানাশোনার মধ্যে কারই বা গাড়ি আছে! আবাঁর বিরাট গাড়ি। কন্ঠাপক্ষ হত চেহারাটা কেমন জানতে পারলে ভালো হত। যার গাড়ি আছে-_তার চেহারা ভালো হওয়াই তো৷ স্বাভাবিক । কিন্ত-_-কে সে ! অলক কৌতুহলে আচ্ছন্ন হয়ে রইল । আজই আসবে, আজ সকালেই, সকাল হতে আর কতই বা দেরি। তার ঠিকানাই বা জানে কে? সুক্রত চৌধুরী নয় তো; সে কেন হতে যাবে! গাড়ি সে পাবে কোথায়! মার্চে অফিসের কেরানী সে-_লটারীতে টাকা পেয়ে ছাড়। গাড়ি কেন! তার পক্ষে অসাধ্য। সুত্রতর বাড়িতে পোষ্য অনেক--তাকে বিয়ে করলে অলকার অশান্তির অন্ত থাকবে না। প্রীতি বললে, “কে রে, অলক ? অলক বললে, নাম বললে না তোকে? নাম কি জিগ্যেস কর! যায়? পৃথিবীর কক্ষাব্তনের মতো৷ অলকার মন গতি-মুখর হয়ে উঠলো]। অনেক দিন আগে বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বটে। শুধু পরিচয়। তার বেশি কিছু নয়। শেষে গন্তব্য স্থানে আসবার আগেই বাসের কণ্ডাক্টার নেমে গিয়েছিল । তখনও টিকিট কাটা হয়নি। কাকে টিকিটের পয়সা দিতে হবে, ভেবে পেলে না। মাত্র তারা ছুজনই হিল বাসের আরোহী । ছেলেটি বলেছিল, “পয়স। দেব কাকে বলুন তো 1, অলকা। বলেছিল, 'আমিও তে। তাই ভাবছি--, কিন্ত বাসের ড্রাইভার এসে পয়সা নেওয়াতে শেষে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তারপর বাস থেকে নেমে পরম্পরের পরিচয় আদান-প্রদান অলক। ঠিকান। দিয়েছিল কিনা মনে নেই । কিংবা যদি দিয়েই থাকে তো এ-বাড়ির ঠিকানা সে জানবে কেমন করে ! চেহারা দেখে মনে হয়েছিল সেদিন, অবস্থা তার ভালোই-_কিস্তু ঠিকানা খোজ করে সে কি আসতে যাবে এখানে ? চারিদিকে সাদা আবহাওয়া । অলক আলোয়ান্টা গায়ে নিবিড় করে জড়ালে। শ্রীতি এখনও ঘুমের ঝৌকে বিছান। জড়িয়ে পড়ে আছে । স্কুলের শিক্ষয়িত্রী সে-ও। ছুজনে একসঙ্গে ভাড়া নিয়েছে এ বাড়িটা । এদের ২৭ কন্ঠাপক্ষ জীবনের কোন স্তরে কোনও বসন্তের পদক্ষেপ কোনোদিন পড়েনি । রুটিনের বাধা-ছকে তাদের জনের গতি আবদ্ধ। অবসরের আমেজ এদের জীবনে অস্তমিত। তবু অলকা আবার হাসলে । দেশ থেকে তার ম1 চিঠি লিখেছে _ন্বান্থ্যের ওপর যেন সে নজর রাখে । স্বাস্থ্য নিয়ে সেকি করবে! তার স্বাস্থ্য নিজের উপকারেই যদ্দি না আসে-_কার উপকারে আসবে ? ঝি এখনও ওঠেনি । এখনও ভাল করে সকাল হয়নি । চা খেলে হত। দূর হোক ছাই--কে আসবে কে জানে! গ্রীতি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। অলক ছাদে উঠে এল। বেশ সকাল হয়েছে। নীল ভোর নয়--এখন প্রাত্যহিক কাজকর্ম নুরু হয়েছে । পাশের বাড়ির কলতলায় বাসন-মাজার শব্দ। দুর থেকে স্টীমারের হুইশল কানে এল। এধার থেকে ওধার পর্ধন্ত পায়চারি করতে অলকার বেশ লাগছে। ছাদের চারপাশে বুক পর্স্ত উচু পাারাপেট,_আচ্ছা, অলকা যদি ছাদ থেকে এখন পড়ে যায়। অবশ্য পড়ে যাবে না। কিন্তু কল্পনা করতে দোষ কী! ধরো সে পড়ে গেল। পড়ে যাওয়া মানে তো মৃত্যু! অবশ্যন্তাবী মৃত্যুর পর তার জন্যে কেউ কাদছে, কিংবা তার মৃত্যুতে কেউ শোকাচ্ছন্ন হয়ে সত্যিকারের বিরহের কবিতা লিখলে-_-এ-কথা ভাবতে বেশ লাগে। সুব্রত চৌধুরীকে বিয়ে করতে অবশ্য অলকার আপত্তি, কিন্তু অলকার মৃত্যুতে সে চিরকুমার হয়ে জীবন কাটিয়ে দিলে--এ কল্পনাতেও যেন আনন্দ! নুত্রতর কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো আর একট। কথা। স্তুত্রত একদিন বলেছিল, “আমার টাক। নেই, তাই প্রমাণ দিতে পারিনে তোমায় কত ভালবাসি-_-, স্বত্রতর কথাগুলো ভালো । কিন্তু কেন তার টাকা নেই? স্ুব্রতর টাক নেই--সে কি অলকার দোষ! সারাজীবন তার দেশের সংসার প্রতিপালন করে এসেছে অলকা--এখন বেশ এমন একজন ছেলে আসে £ প্রচুর অর্থ, অদম্য স্বাস্থ্য, অখণ্ড আরামের আর অপরিমিত প্রেমের প্রাচুর্ষে _যার সঙ্গে সে নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়ে দেবে! এ-জীবনে কোনও বৈচিত্রা নেই__আছে কেবল কল্লোল-ফেনিল সমুদ্রন্বাদের তিক্ততা । তা বলে সেই ভেবে অলক! কাদতে বসবে নাকি-_কীদাট। কিন্ত ন্তাকামি। সেকি অত কন্তাপক্ষ ২৮ ছর্বল! নাই বা এল প্রেম, নাই বা এল শাস্তি, নাই বা এল স্বাস্থ্য-_ রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটা 1 কেউ যদি না আসে, একল। যেতে হবে। একলাই যেতে হবে তাকে । তা! বলে স্ুব্রতকে বিয়ে করে জীবনটা ব্যর্থ করে দেওয়া কোনে কাজের কথা নয়। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে ও-বাড়ির বউ ছাদে ওঠে । তারই মুখে শোন। £ এ-বাড়িতে নাকি আগেও মেয়েদের একটা মেস ছিল। তাদের এক- একজনের এক-একরকম নাম। ব্উটি বলে,_-“এএকজন আবার নাচত ভাই, জানেন, জানলা দিয়ে কন্দিন উকি মেরে দেখেছি, কিন্তু ভাই, এতটুকু দেমাক ছিল না তাদের । কতদিন রান্না তরকারি পাঠিয়ে দিয়েছি, বেশ ছিল তারা." “তারপর. বউটি খুব গল্প করতে পারে। গল্প বেশিক্ষণ জমে না। গল্প করলে কি অলকার চলে ! অলকার তিন-তিনটে টিউশানি, তারপর আবার দুপুরবেলা স্কুল। দেশে মা, ছু'টি নাবালক ভাই, ছোট একটা বোন। তাদের ভরণপোষণ তাকেই তো৷ করতে হয়। মাসের প্রথম দিকে তার টাকার আশায় পিয়নের পথ চেয়ে বসে থাকে । এমনি তো। দেখতে বেশ, রিকৃশ। করে স্কুলে যায়_কারোর সাতেও নেই পাঁচেও নেই। কিন্তু ছু'পকেটের মধ্যে যার সংসার, পেছন বলতে কিছু নেই, তার বাঁচা-মর ছুই-ই তো! সমান। অলকা পায়গরি করতে করতে ভাবলে-_জীবনে তার পরম বন্ধুও কেউ নেই, পরম শত্রও কেউ নেই । অলকার ইচ্ছে হয় প্রাণভরে কাউকে ভালবাসে । কারোর জন্যে সে জীবনপাত করে। সুব্রত চৌধুরীর কথা মনে পড়লে ৷ সুব্রত একবার চিঠিতে লিখেছিল £ যেদিন আমাকেও ভূলে যাঁবে, সেদিন শুধু মনে রেখ আমার এই কথাটা-_ভালোবাসা জীবনে এক নিদারুণ অভিশাপ |! তুমি যদি সুব্রত হতে আর আমি হতেম অলকা-তা৷ হলে বুঝতে কথাটা কত বড় সত্যি! সুব্রত সত্যি কথা ছাড়। বলে না। অলক ভাবলে-_তত্বকথ। সবাই জানে, সবাই বলে, তার কোনও মূল্য নেই। অলক তো উপবাস করতে পৃথিবীতে আসেনি । তুমি কিছু দেবে, আমি কিছু নেব--তবেই না৷ প্রেম ! ২৯ কন্ঠাপক্ষ অলকা হেসে উঠলে । প্রেম কথাটা ভাবলেই হাসি আসে যেন অলকার ভারি তো! জীবন--এক ফুঁয়ে উডিয়ে দেওয়া যায় । কোথা দিয়ে এই কুঁড়িট! বছর কেটে গেল । যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তারা থাকেনি কেউ ! ক্ষণ- স্থায়ী বুদ্বুদ সব। কিন্তু সুব্রত তাকে যে কী চোখে দেখেছে কে জানে। তার মুখের ওপর অলক! রূঢ় কথ। কিছু বলে না সত্যি- কিন্তু সুব্রত তো বোক। নয়, বোঝে সব। তবু অলকাঁকে ভূলে যাবার ক্ষমতাও তার নেই। হাজার বার সে আঘাত পাবে, তবু আঘাত করবে না একবারও । সত্যি, সুব্রতর মেয়ে হওয়াই উচিত ছিল যেন। একটা কথা৷ ভেবেই 'অলকা! হেসে উঠলে দূর, তা কখনও হয় ! অনেকদিন আগের সেই সতীজীবনকে তার মনে পড়লো । ইউনিভাপ্সি- টিতে পড়তে।। রোজ ক্লাসের ছুটির সময় এসে দাড়াতে! কলেজের সামনে । বড়লোকের ছেলে--একসঙ্গে গল্প করতে করতে আসতো তার হোস্টেল পর্যন্ত । মাত্র মাস ছুই-এর পরিচয় । সে-পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হবার স্যোগ হয়নি। একদিন হঠাৎ আর সে আসেনি । শুনেছিল বিলেত চলে গেছে--! কিন্তু এতদিন পরে সতীজীবন কি তার খোঁজ করতে এসেছিল ! একখানা কেন, সে অবশ্য দশখান। মোটর কিনতে ।পারে। কিন্তু সেই যদ্দি এসে থাকে আজ ! যেমন অনেকেই বলেছে, সতীজীবন তেমনি ধরনের কথাই বলতে। তাকে । পুরাতন বাঁধা-ধরা সব কথা । বড়লোকদের মুখ থেকে যে-সব কথা শুনলে আনন্দ হয়--রোমাঞ্চ হয়। অলক তার চেহাঁরাট। একবার মনে করবার চেষ্টা করলে । কতদূর পর্যন্ত তার। এগিয়েছিল তাও আজ মনে নেই। সামান্য একজন কলেজের মেয়ে সে তখন, আর কলেজে-পড়া বড়লোকের ছেলে সে। সে-তে। প্রায় চার-পাঁচ বছর আগেকার কথা । এতদিন পরেও তাকে মনে রেখেছে নাকি সে! দূর-_তাও কখনো হয় ! 'দিদ্িমণি !, অলক পেছনে ফিরলো । ফিরেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো ।- কেউ এসেছে নাকি ! কন্াপক্ষ ৩৩ কেউ এসেছে? চ] চড়িয়েছি, ডাকতে এলুম, হাতমুখ ধুয়ে নাও-_+ তবু যা হোক কেউ আসেনি)! মঙ্গল। ভয় পাইয়ে দিয়েছিল বইকি। মঙ্গল! বললে, “কাল একজন বাবু তোমায় খুজতে এসেছিল-_ছু'বার। আমি বললাম, রাত্তিরে তে। দিদিমণি থাঁকে না, পড়াতে যায়-_, অলক। উদ্গ্রীব হয়ে বললে, “আমার নাম বললে নাকি রে ? মঙ্গল! বললে, “তামার নাম করেই তো বললে । আজ সকালেই আবার আসবেন বলে গেছেন । অলকার বিম্ময়ের সীমা নেই। বললে, “কি রকম চেহারা দেখলি-_ ফরসা, লম্বা, আর কৌকড়া কৌকড়া চুল,;না ? অলকার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল যেন। মঙ্গলা বললে, গাড়ি ঈাড়িয়েছিল রাস্তায়--মস্ত গাড়ি, সাহেবের পোষাক পরা কোথায় আর বসতে বলি, তাই সকালে আসতে বললাম ।; অলক বললে, ভালোই করেছিস ।, ভালে করেছে কি মন্দ করেছে তা কে জানে! কিন্তু অলকার মনে হল-_এ কেমন করে হয়! সতীজীবন ঠিকানা কেমন করে সংগ্রহ করলে এ-বাড়ির | পাঁচ বছর-্পাচ বছরের দীর্থ ব্যবচ্ছেদে মানুষের এত কথা মনে থাকে ! আশেপাশের বাড়িগুলো কলমুখর হয়ে উঠলো.। পৃথিবীতে ব্যস্ততা! নেমেছে। মঙ্গল! বললে, “তুমি এসো দিদিমণি, আমি চায়ের কুলি নামা ইগে_-১ হঠাৎ কী যে হল, অলক সেই প্রাতঃহৃর্ষযের দিকে চেয়ে-_-যা কখনও করেনি- লজ্জায়, আনন্দে, বিস্ময়ে, প্রত্যাশায় কাকে জানিন। উদ্দেশ করে বললে, শাস্তি দেওয়ার কথ! তোমার নয়, আনন্দ দেওয়ার কথাও তোমার নয়, তবু এই মুহুর্তের প্রশান্তিকে উপলক্ষ্য করে আমি তোমায় আমার প্রণাম জানাই। তারপর নিজের ছেলেমামুষিতে অলকা! নিজেই যেন লজ্জিত হয়ে উঠলো । ভাগ্যিস কেউ দেখেনি । বাজে কথা সব বাজে কথা ! সবচেয়ে তাকে প্রথম ভাবতে হবে- কেমন করে তার আরো বেশি ৩১ কন্ঠাপক্ষ টাক! রোজগার হয়। তিনটে টিউশানি থেকে তার উপায় হয় পঁয়তাল্লিশ টাকা, আর স্কুলের ষাট টাকা । একশে! পাঁচকে বাড়িয়ে একদিন একশে। দশ করতে হবে-দশ থেকে বিশ, বিশ থেকে ত্রিশ- ত্রিশের অঙ্ক তারপর ধীর গতিতে বাড়তে থাকে ! কিন্তু সে এত ভাবে কেন ! কাউকে যদি সমস্ত মনের কথ! বল! যেত ! সমস্ত--সমস্ত ! এখন এই সকালবেলা টেলিফোনেও কাউকে সব বলা যেত যদি | বন্ধু তার কেউ নেই! এখনি প্রীতি ছুটবে টিউশানিতে। দেখ। হবে যাবাব সময় । কথা বলবারও সময় নেই তার। নিচে থেকে মঙ্গলা ডাকলে, “দিদিমণি !, অলকা শঙ্কিত হয়ে উঠলো, এসেছে নাকি ? মঙ্গলা বললে, চা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল এদিকে__ তবু যা হোক-_-অলকা খানিকট। স্বস্তি পেলে। আসেনি এখনও । কিন্ত এই তে। সকাল হয়েছে! এখনি যে-কোনে। সময়ে হাজির হতে পারে । অলক। দভ্রত পায়ে নিচে নেমে এল । ছোড়দিমণি চলে গেছে । দৈনন্দিন কারধতালিকার ঘূর্ণাবর্তে তার মতোই গ্বীতির চলাফেরা আবদ্ধ । আজ সকালে আর অলকা' পড়াতে যাবে না। কাল যে ছ'বার এসে তাকে খুঁজে ফিরে গেছে_আজ তাকে আর ফিরতে না হয়। হয়তো তাতে অলক:রই লাভ ! বিছানা ছটে। পরিষ্কার করে অলকা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে । দেওয়ালের আলনায় শাড়ি আর সেমিজের ভিড়, সেগুলোও গোছাতে হল। অপরিষ্কার আর অপরিচ্ছন্নতার পাহাড় হয়ে ছিল। যদি এই ঘরেই তাঁকে আনতে হয় ! অলক। নিজে হাতেই ঝ'টা ধরলো । পালিশ-ওঠা টেবলটার ওপর চায়ের দাগ। হঠাৎ ঘরের আর আসবাবপত্রের অপরিচ্ছন্নতা যেন অলকার চোখে নতুন করে নিলজ্জ হয়ে উঠলো । আগে তো অমন মনে হয়নি কোনদিন। মোটরে করে যারা আসে তাদের পরিচ্ছন্নতা-বোধ সম্বন্ধে আতিশয্য থাকাই স্বাভাবিক । মা'র দেওয়া ঘিয়ের ময়ল। জারট! পাশের ভাড়ার ঘরে লুকিয়ে ফেলতে হল। তারপর দেওয়ালের যতগুলো! কন্থাপক্ষ ৩২ পেরেক আর দড়ি সব নিজের হাতে খুলতে হয়। আগাগোড়া ঘরখানায় পারিপাট্যের ক্রটি কোথাও না থাকে । পাঁচ বছর পর বিলেতের শিক্ষা নিয়ে ফিরে এসেছে! সতীজীবনের আকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে অলক। তার সৌন্দর্য-বোধ সম্বন্ধে একটা সুস্পষ্ট ধারণ। গড়ে নিলে । অর্থাৎ সর কিছু নিয়ে এই ঘরে সতীজীবনকে তার পাশে মানায় কিনা তাই ভেবে অলকা ব্যস্ত হয়ে উঠলো । কিন্তু সকাল তো অনেকক্ষণ হয়েছে-_অনেক ক্ষণ ! একটা রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিতে নিজেকে বসিয়ে ভাবতে বেশ লাগে । নিতান্ত নিরিবিলি ঘর--এখন বাইরের কেউ আসছে না। গ্রীতি ঘণ্টা ছু'য়েক পরে আসবে । বেশি ভাবতে অলকার লজ্জা হল। নিজের শাড়িটাও অলকা৷ বদলে নিলে এক ফাকে । আচ্ছা, যদ্দি এমন হয়_-এমন যদি হয়ে-''কিন্ত পরমুহূর্ঠেই অলকার সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল । মোটরের আওয়াজ যেন কানে এসেছে হঠাৎ? অলকার মনে হল যেন স্ুনিয়ন্ত্রিত মৃত্যু তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। , এ যেন সুব্রত চৌধুরীর অলকা নয়, স্কুলের মেয়েদের অস্ক-দিদিমণি নয়__ নিতান্ত সাধারণ-অসাধারণত্বের গণ্ডির বাইরে ত্রস্তা ভয়-সচকিত। অলক একান্তভাবে**" আর ভাবা গেল না । মঙ্গল৷ ডাকলে, “দিদিমণি-_ মঙ্গলার ডাক শুনে অলকা। নিচে নেমে এল। -_এই যে অলক দ্রিদিমণি__- মঙ্গল? এগিয়ে এল। ভদ্রলোকও এগিয়ে এলেন-__ “আপনি 1. ভদ্রলোকের কণে বিস্ময় ও লজ্জা । বললেন, 'আঁমি অলকা! দেবীকে খু'জছিলাম-__+ অলক! বললে, “আমার নামই অলকা__ ভদ্রলোক বললেন, “মাপ করবেন, এটা।কি বারোর সি? আপনারা কি এ-বাড়িতে নতুন এসেছেন ? ৩৩ কন্তাপক্ষ অলকা বললে, ইযা'_ ভদ্রলোক বললেন, এখানে আগে যারা ছিল তাদের ঠিকান। বলতে পারেন ? তারপর হঠাৎ একটা ছোট নমস্কার করে ভদ্রলোক চলে গেলেন । অলকার মনে হল-_মুত্তিকা! যেন সেই মুহূর্তে দ্বিধা হল, আর অলকা অকুষ্ঠিত চিত্তে তার মধ্যে প্রবেশ করলো । অলকা স্পষ্ট দেখতে পেলে তার মাইনে সত্তর থেকে আশি, আশি থেকে নববুই, নববুই থেকে একশোৌ-_ তারপর একশো"র অস্ক ধীরগতিতে বাড়ছে .. তারপর একদিন অলকাকে আরো বড় বাড়ি ভাড়া নিতে হবে, আরো ভালো শাড়ি, আরো গয়না । মাকে আনতে হবে। এখানে এই শহরের একটা নিরিবিলি পাড়ায় আরো এশর্ধবান হয়ে দিন কাটাতে হবে । আর কিছু নয়, আর কিছু নয়, শুধু এইটুকু মাত্র। এর বেশি চাওয়া তার পক্ষে যেন অন্যায়, যেন অনধিকার-চ1 1 একটি মুহূর্ত! কেবল একটি মুহুতেরি জন্যে অলক পালের জীবনে যৌবন এসেও অপমানিত হয়ে ফিরে গেল সেদিন । গল্পটা কী জানি কেন সোনাদিকে দেখাইনি। দেখাতে লজ্জা হয়েছিল বুঝি! কিংবা হয়তো তখন সোনাদির অসুখ বেড়ে উঠেছিল। সোনাদির ছিল অদ্ভুত অস্থুখ। খাওয়া-দাওয়া সবই ছিল স্বাভাবিক মান্থুষের মতো ! সবই খায়, সবই করে, কিন্তু সারাদিন শুধু শুয়েই থাকে । শুয়ে শুয়ে শুধু বই পড়ে কিংবা জানালা দিয়ে চোখ মেলে থাকে আকাশের দিকে । কিংবা আমার সঙ্গে গল্প করে, কিংব! চিঠি লেখে । আমার এই যে বই লেখার নেশা, এর পেছনেও ছিল সোনাদির আগ্রহ ! সেদিন যে-মানুষট? উৎসাহ দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে, ভালো-মন্দ বুঝিয়ে দিয়ে আজকের আমিকে চিনিয়ে দিয়েছিল, সে তো আমার সোনাদি। কবে একদিন একটি নিঃসঙ্গ ছেলে নিজেকে প্রকাশ করবার ভাষ। খু'জেছিল পৃথিবীর বিচিত্র মানুষের মধ্যে কন্তাপ্ ৩৪ দিয়ে, সে নিজেও বুঝি তা এতদিন জানতো না। নিজের লজ্জা ঢাকবার জন্তেই মাঝে মাঝে গল্প লেখার চেষ্টা করতো। মুখ-চোরা সেই ছেলেটি অবাক হয়ে ভাবতো যেন সে বড় অনাবশ্তক এখানে ! ভয় হত-মানুষের প্রতিযোগিতার ভিড়ে সে বুঝি হারিয়েই যাবে একদিন ! কেউ তার কথা ভাববেও না, বুঝবেও না, মনেও রাখবে না। বেদনার বুঝি শেষ ছিল ন! তার তাই। তাই রাস্তার একপাশে সকলের ভিড় বাচিয়ে সে চলেছে। সকলের চোখ এড়িয়ে সে বে'চেছে ! পরীক্ষার বই পড়ার ফাকে ফাকে রাস্তার লোক চলাচলের দিকে চেয়ে সে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে বার বার। মাস্টারের সহানুভূতি সে পায়নি । বাপ-মায়ের অনাদূত অপোগণ্ড সেই সম্তান। ইস্কুলের আর পাড়ার ছেলেদের বিদ্ধপের পাত্র হয়ে দিন কাটিয়েছে সে একলা । এমনি সময় একদিন সোনাদির সঙ্গে দেখা । সেদিন সোনাঁদিকে পেয়ে যেন সত্যিই বেঁচে গেলাম আমি ! কিন্তু দিদি সম্পর্ক তো পাতানো । কবে একদিন সোনাদির বংশের কেউ আমাদের দেশে বুঝি থাঁকতেন। সেও তিন পুরুষ আগের কথা! সোনাদির বংশের কে বুঝি একদিন ছিটকে বেরিয়ে পড়েছিলেন গ্রাম থেকে । তারপর যশ, প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি কিছুরই অভাব হয়নি সেখানে । বাংলাদেশ থেকে দূরে পরিবারের শাখা-প্রশাখা বেড়েছে । আত্মীয় স্বজন সকলকে পায়ে ভর দিয়ে দাড়াবার সুযোগ করে দিয়েছেন। সোনাদি সেই বংশের মেয়ে। তারও বিয়ে হয়েছিল একদিন জববলপুরে । স্বামী নিয়ে স্রখে ঘর করতে পারতো সোনাদি। কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি সে- কথা এখন থাক । সোনাদিকে দেখে আমার কিন্তু আর একজনের কথা মনে পড়তো প্রায়ই! সে আমার মিষ্টিদিদি। মিগ্িদিদিও সোনাদির মতো শুয়ে থাকতো সারাদিন ! কিন্তু মিষ্টিদিদির অসুখটা ছিল একট প্রকাণ্ড রহন্ত । শুধু আমার কাছেই যে রহস্ত তা নয়, সকলের কাছেই। সেই মিষ্টিদিদির কথা৷ এবার বলি-_ মিষ্টিদিদি আমার আপন দিদিও নয়, দূরসম্পর্কের দিদিও নয়। ৩৫ কন্ঠাপক্ষ তবু মিষ্টিদিদি ছিল বুঝি আমার আপন দিদির চেয়েও বড়। বলতো, “যে-কট। দ্রিন বেঁচে আছি, তুই আমার কাছে কাছে থাক্‌, জানিস । মিষ্টিদিদি সময় পেলেই চুপচাপ শুয়ে থাকতো।। পাতল। হালক। শরীর, ধবধবে রং। ফিন্ফিনে সিক্ষের শাড়ি গায়ের ওপর থেকে খসে খসে পড়তো । ইজি-চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে শ্প্িং-এর খাটে শুতো৷ একবার, তারপর হয়ত তখনি আবার উঠে গিয়ে বসতো বাগানের দোলনায়। তারপরেই হয়ত খেয়াল হল--তখুনি গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গঙ্গার ধারে। জামাইবাবু আমাকে দেখিয়ে বলতো, “ওকে সঙ্গে নিয়ো, মিষ্টি কোথাও যদি হঠাৎ টলে পড়ে যাও, তখন-_ মিষ্টিদিদিও মাঝে মাঝে বলতো, “তাদের সবাইকে খুব কষ্ট দিচ্ছি রে আমি-_, আমি বলতাম, “বাঃ কষ্ট কিসের !, মিষ্টিদিদি বলতো, “না, তোর জামাইবাবুর দেখ তো, কখনও কোন অন্ুখ হতে দেখিনি । আমার জন্তেই তো কোথাও যেতে পারে না, আমার জন্যেই তো৷ এত চাকর-বাকর রাখী । শঙ্করকেও দূরে পাঠাতে হল তে। শুধু আমার শরীরের জন্যেই |” মিষ্টিদিদির ঝি অবশ্য থাকতো। সঙ্গে । মি্রিদিদির সঙ্গে দিনরাত পাল করে একটা-না-একটা ঝি থাকেই । রাত্রে ষদি মিষ্টিদিদির ঘুম না আসে, ওই একজন বি পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে ঘুম পাড়াবে। শাড়ি যদি কাধ থেকে হঠাৎ খসে যায় মিষ্টিদিদির, তো একজন ঝি কাপড়টা তুলে দেবে যথাস্থানে । খেয়ালের তো অন্ত নেই মিষ্টিদিদির। কখন কী খেয়াল হবে মিষ্টিদিদি নিজেও বলতে পারে না আগে থেকে । হয়ত রাত্তির দশটার সময়েই মি্রিদিদির তপসে মাছ ভাজ। খেতে ইচ্ছে হতে পারে। আশ্বিন মাসের ছুপুরবেলাতেই ল্যাংড়া আম খেতে ইচ্ছে হতে পারে। জামাইবাবু হয়ত তখন আফিসে যাচ্ছে, মিষ্টিদিদি বললে, “আমার বুকটা কেমন করছে, তুমি আজ যেয়ো না কোথাও |, কন্যাপক্ষ ৩৬ জামাইবাবু তখন কোটপ্যান্ট পরে তৈরি । নিচে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। বললে, “আমার যে আজ একটা জরুরী কাজ ছিল ।, মিষ্টিদিদি বলতো “তা বলে কাজটাই তোমার বড় হল ?' জামাইবাবু কেমন যেন অপ্রস্তুত ব্যস্ততায় বলতো» “আমি বরং গিয়ে ডাক্তার সান্যালকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ।, মিষ্টিদিদ্রির পাতল। শরীর যেন কান্নায় ফুলে ফুলে উঠতো । বলতো, “আমি আর ক'দিন! আমি মরে গেলে তুমি যত খুশি কাজে বেরিয়ো। না, কাজ তো৷ তোমার পালিয়ে যাচ্ছে না।” সত্যিই তো তখন আমাদেরও মন হত মিগ্রিদিদি আর ক'দিনই ব। বাচবে। কলকাতার হাট-স্পেশালিস্টরা কেউ রোগ ধরতে পারতো ন! মিষ্টিদিদির। কতবার কলকাতার বাইরে থেকে ডাক্তার এসেছে । ভিয়েন। থেকে এসেছে । আমেরিক থেকে এসেছে । জামাইবাবু মোটা৷ মোটা টাক দিয়ে সব রকম চিকিৎসা করিয়েছে । কেউ রোগ ধরতে পারেনি । কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই একমত হয়ে বলে গেছে, রোগীর মনে কোনে রকম উত্তেজনা! হতে দেওয়া! উচিত নয়। একটু উত্তেজনা হলেই আর বাচানো যাবে না রোগীকে । মিষিদিদি বলতো, “আমি মরে গেলে তুমি যেমন খুশি যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়িয়ো, আমি দেখতেও আসবে! না। কিন্ত যে ছু'টো দিন বেঁচে আছি, আমাকে দয়। করে শান্তিতে বাঁচতে দাও ।, তা মিগ্রিদিদিকে শান্তিতে'বাচতে দেবার জন্যে জামাইবাবুও কি কস্ুর করতো কিছু ! দু'টো দিন-_ অথচ “ছু”টে। দিন” “ছু*টে। দিন” করে কতদিন যে বেঁচে থাকবে মিষ্টিদিদি, আমি কেবল তাই ভাবতাম । তবে অপূর্ব স্বাস্থ্য বটে জামাইবাবুর | একট দিনের জন্য অস্থুখ করেনি, একদিন সর্দি হল না। চল্লিশ বছরের জামাইবাবুকে যেন পঁচিশ বছরের ছোকর! মনে হত দেখে । ভোরবেলা উঠতো । উঠে সামনের সমস্ত বাগানটা জোরে জোরে হেঁটে নিত দশ-পঁচিশ ৩৭ কন্ঠাপক্ষ বার। একদিনও শুনিনি যে জামাইবাবুর মাথা! ধরেছে । কখনও ডাক্তারের কাছে সঁপে দিতে হয়নি নিজেকে । কবে যে ওষুধ খেয়েছে তা মনেই পড়ে না জামাইবাবুর । এমনি অটুট স্বাস্থ্য । এমনি আট শরীর । কিন্তু তবু জামাইবাবুকে গঞ্জনা শুনতে হত মিষ্টিদিদির কাছে। রবিবার । খাবার টেবিলে হয়ত সবাই খেতে বসেছি। জামাইবাবুও খাচ্ছে একমনে । মিষ্টিদিদি বললে, “ওমা, ওই অতগুলো! মাংস তুমি সত্যি সত্যি খাবে নাকি ? কেমন যেন লজ্জিত হয়ে পড়ল জামাইবাবু । কী বলবে যেন ভেবে পেলে না। তারপর মাংসের প্লেটটা পাশে ঠেলে দিয়ে বললে, তাইতো, আমাকে বড্ড বেশি মাংস দিয়েছে দেখছি, ঠাকুর । মিষ্টিদিদিকে আমি লক্ষ্য করেছি তখন। ঝাঁল ড'টা-চচ্চড়ি একরাশ নিয়েছে পাতে । বার বার চেয়ে-চেয়ে ভাতও নিয়েছে এক হাড়ি। পোনা মাছের কাঁলিয়ার সবটাও শেষ করে ফেলেছে ! কাটাগুলে। পর্ষস্ত চিবিয়ে চিবিয়ে গুড়ো করে ফেলেছে মিষ্টিদিদি। তারপর নিঃশব্দে কখন মাংসের প্লেটটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর আরো মাংস দিয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই । আমাদের ছু'জনের ডবল খেয়ে কখন শেষ করে হাত গুটিয়ে বসে বসে ডাট। চিবোচ্ছে মিষ্টিদিদি। জামাইবাবু লক্ষ্য না করুক, আমি তা করেছি । তবু মিষ্টিদিদি ভাটা চিবোতে চিবোতে বললে, “বেশি খেয়ো না বলে দিলাম, ওতে মানুষের স্বাস্থ্য ভালে থাকে না।, জামাইবাবু বললে, “কই, আমি তে। বেশি খাইনি । মিষ্টিদিদি বললে, “এক একজনের ধারণা, একগাদা খেলেই বুঝি শরীর ভালে থাকে । ওটা ভুল ।' জামাইবাবু বললে, “নিশ্চয় |; এমন জময় ঠাকুর বললে, “মা, আমড়ার চাঁটনি করেছিলুম দিতে ভুলে গেছি।, কন্ঠাপক্ষ ৩৮ মিষ্টিদিদি বললে, "ভুলে গেছ ভালোই হয়েছে-_ওঁকে আর দিয়ো না । আমার এই প্লেটে বরং একটুখানি দাও, কেমন রে'ধেছ চেখে দেখি ।' তারপর আমার দিকে চেয়ে বললে, “তুই নিবি নাকি একটু ? বললাম, “তা দিক্‌ একটুখানি ।” মিষ্টিদিদি বললে, “না না, থাক্‌ তোকে আর নিতে হবে না। এই বয়েস থেকে বেশি খাওয়া অভ্যেস করিস নে তোর জামাইবাবুর মতো । পেট ভরে খাবি না৷ কখনও, এই বলে রাখলুম । একটু খালি রেখে খেতে হয়।? ত৷ ঠাকুর শুধু আমড়ার অন্বলই দিলে না । পুরনো ঠাকুর জানে সব! শুধু অশ্বল মিষ্টিদিদি খেতে পারে না। সঙ্গে ছুটি ভাত চাই। ঠাকুর ভাতও এনে দিলে মিষ্টিদিদিকে | ঠাকুর বললে, “আর ছু'টে। ভাত দেবো, মা ? তখন সব ভাত নিঃশেষ হয়ে গেছে । মি্রিদিদি বললে, “না না, পাগল হয়েছ ঠাকুর। একে দেখছ আমার শরীর খারাপ- আমাকে কি তুমি খাইয়ে খাইয়ে মেরে ফেলতে চাও নাকি !, কী জানি আমার কেমন জামাইবাবুকে দেখে মনে হত তাঁর যেন পেট ভরেনি। এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে উঠে পড়তো জামা ইবাবু। মিষ্টিদিদি বলতো, খেয়ে উঠে যেন এখনি আবার শুয়ো না গিয়ে ঘরে |" না না, শোব কেন, এখন আমার কত কাজ ।; মিষ্টিদিদি বলতো, “না, তোমার ভালোর জন্যেই বলছি, খেয়ে উঠে শুলেই যত অন্বল আর চৌয়৷ ঢেকুরের উৎপাত ।” জামাইবাবু তারপর নিজের ঘরে চলে যেত। আর মিষ্টিদিদ্ির তখন নিজের স্প্রিং-এর খাটে শুয়ে থাকবার পালা । বলতো, “আমার যে কী কপাল |! ইচ্ছে না হলেও মট্‌ক মেরে পড়ে থাকতে হবে বিছানায় ।, সেবার জামাইবাবুর একটা মস্ত প্রমোশন হল আপিসে। শুধু প্রমোশন নয়। সমাজে, পাড়ায়, আপিসে সর্বত্র সেটা হিংসে উদ্রেক করার মতো। প্রমোশন। অর্থবান মানুষ জামাইবাবু। একসঙ্গে ছু'তিনখান। ৩৯ কন্ঠাপক্ষ গাড়ি রাখবার মতন অবস্থা । ব্যাঙ্কের আথিক ক্ষীতিটাও উল্লেখযোগ্য । মথচ সমস্ত নিজের চেষ্টায়। অল্প অবস্থা থেকে শুধু কর্তব্যনিষ্ঠা আঁর পুরুষ- কারের জোরে বাঁড়ি গাড়ি আর মিষ্টিদিদির মালিক হতে পেরেছে । বিয়ের আগে মিষ্টিদিদিকে চিনতাম না। তবে শুনেছি মিষ্িদিদির কথ!। মা বলতো, “সে রীতিমত লড়াই বেধে গিয়েছিল মিষ্টির বিয়ের সময়ে। পটল বলে, আমি বিয়ে করবো, চাইবাসার ডেপুটি ম্যাজিস্টেট অরুণ বললে, আমি বিয়ে করবো- দিনরাত মনোহরদার বাঁড়ি দশ-বিশট। ছেলের ভিড়-- টেনিস খেল। চলে ওদের, আর মিষ্টি বাগানে একটা বেতের চেয়ারে বসে বসে খেলা দেখতো আমি জিগ্যেস করতাম, “মিষ্টিদিদি খেলতো৷ না, মা? হ্যা, ও আবার খেলবে কী! ও তো! কেবল ওর শরীর নিয়েই ব্যস্ত। ওর জন্যে মনোহরদ। পর্যন্ত ফতুর হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত, কেবল ডাক্তার আর ওষুধ-_কী যে রোগ কেউ বলতে পারে না, শুধু বলে বিশ্রাম নিতে হবে। ওই মেয়েকে নিয়ে মনোহরদাকে কি কম ভূগতে হয়েছে! শেষে মনোহরদ! সকলকে ডেকে বললে,_ আমার মেয়েকে যে বিয়ে করবে তাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, মেয়েকে কখনও খাটাবে না, কখনও কাজ করাতে পারবে না ! ভালে! ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে যেমন আমি করছি । শুনে সবাই রাজী, বড় বড় লোকের ছেলে সব-_বড় বড় চাকরি করে, হাজার দেড় ছুই টাক1 করে সব মাইনে পায়। শুনে আমরা তো। চাইবাসার মেয়েরা সব হেসে বাঁচি নে। ওই তো পাতিল হাড়-জির্জিরে চেহারা, কদিন আর বাঁচবে, একটা ছেলে হলেই হাঁড্ডিসার হয়ে যাবে-_-তা কী সব আজকালকার ছেলেদের পছন্দ জানিনে মা, সবাই বলে রাজী ।, বাবা বলতেন, “তা রোগ। হওয়াই তো ভালো, খাবে কম 1, মা বলতো, “হ্যা খাবে নাকি কম, কথা শোনো দিনরাতই যে খাচ্ছে কেবল, কী করে হজম করে মা, কে জানে! মনোহরদ। তো ওই মেয়ের জন্যেই দেউলে হয়ে গেল শেষকালে, কাঠের ব্যবসা ছিল মনোহরদার। তা৷ মেয়ের খাওয়ার জ্বালায় দেনা হল চারিদিকে । সকাল থেকে উঠেই মেয়ের কন্তাপক্ষ ৪০ খাওয়। ; মুখে একটা-না-একট1 কিছু লেগেই আছে। চকোলেট, বিস্কুট, লজেঞ্জ, মাংস, মাছ, শাক, খাছ্য-অখাগ্য কিছু তো। আর বাদ নেই! বাবা বলতেন, “তা যদি হজম করতে পারে, ক্ষতি কী? মা বলতো, 'তুমি আর ঠেস্‌ দিয়ে কথ। বোলো! না বাপু, এই তো এত- দিন এসেছি তোমার সংসারে, কেউ বলুক দ্রিকিনি আমার জন্যে কট পয়স৷ তোমার খরচ হয়েছে ডাক্তারের পেছনে ? বাবা হেসে উঠতেন হো! হো করে । আর মা থেমে যেতে গন্তীর হয়ে। আমি বাধ। দিয়ে বলতাম, “মা, তারপর--তারপরে কী হল? মা বললে, “তারপরই বাধলে! গোল। সবাই যখন রাজী তখন মনোহরদা উপায় ন। দেখে বললে,_মিষ্টি যাকে বেছে নেবে তার সঙ্গেই ওর বিয়ে দেব। তা ওদের মধ্যে পটলই ছিল সবচেয়ে মজবুত, দৌড়তে পারতো, কম বয়েস, নিজের চেষ্টায় মানুষ হয়েছে, কুস্তিকর। চেহারা । মিষ্টির বরাবর রাগ ছিল পটলের ওপরে-_” জিগ্যেস করলাম, “রাগ ছিল কেন, মা? “তা রাগ থাকবে না? মিষ্টি নিজে হাওয়ায় উড়ে যায়, একটু কাজ করলে মাথা ঘোরে, ঘুম না পাড়ালে ঘুম আসে না, তার চোখের সামনে অত মজবুত চেহারার মানুষকে ভালে! লাগবে কেন? তা মিষ্টি শেষ পর্যস্ত পটলকেই বিয়ে করতে রাজী হল ।' এসব ছোটবেলায় মার কাছে গল্প শুনেছিলাম । তারপর যখন ম্যাটি,ক পাস করে কলকাতায় পড়বার কথা হল, তখন পটল-জামাইবাবুই লিখলে, “ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন, এখানে থেকেই লেখাপড়া করবে ও, কোন অন্ুবিধে হবে না।; আসবার সময় মা বলে দিয়েছিল, “বাড়িতে যেন বেশি গোলমাল কোরো না বাবা__-একটি মাত্র ছেলে শঙ্কর, তাকে পর্যন্ত কাছে রাখেনি পটল, পাছে মিষ্টির শরীর খারাপ হয়__, আমি যখন মিষ্টিদিদির বাড়িতে প্রথম এলাম, তখন শঙ্কর থাকতে। দেরাদুনে। হাঙ্গারফোর্ড স্বীটে বাড়ি করার পেছনেও ওই সেই একই ৪১ কন্ঠাপক্ষ কারণ। এ পাড়ার অধিকাংশ অধিবাসী সাহেব-সুবো। বিরাট দশ বিঘে জমির ওপর বাড়ি। ঘন গাছপালা । বাঁড়ি থেকে রাস্তা ব। পাশের বাড়ি পর্ধন্ত দেখা যায় না। কোনো রকম শব্দ আসে না এখানে । নিঝুম নির্জন আবহাওয়া । শুধু এক-একবার এক-একটা। পাখির ডাক ছুপুরবেলার শাস্তি ভঙ্গ করে। শঙ্কর যখন জন্মাল, সেই প্রথম দিনটি থেকে তার ভার নিয়েছিল নার্সপ। দিনের মধ্যে এক-একবার মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে মিষ্টি দিদির কোলে রাখা হত। কিন্ত জামাইবাবুর হুকুম ছিল-_-শঙ্কর কাদলেই দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, একেবারে মিষ্টিদিদির কানের এলাকার বাইরে। ভয় ছিল, ছেলের কান্না শুনলেই মিষ্টিদিদির হার্ট-ফেল হতে পারে। মি্রিদিদি যদি থাকতে দক্ষিণের ঘরে, শঙ্করকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে একেবারে সুদূর উত্তরে। হয়ত একেবারে বাগান পেরিয়ে ওদিকের মালীদের ঘরে। যেখানে ছেলে ককিয়ে কাদলেও মিষ্রিদিদির স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা নেই। সেই ছেলে ক্রমে এক-বছর বয়েসের হল। ছু'বছরের হল। বড় জ্বালাতন করতে লাগলো! তখন। হুড়মুড় করে দৌড়ে বেড়ায়, কান ঝালাপাল৷ হয়ে যেত। সেই গোলমালে একদিন মিষ্টিদিদি হার্ট-ফেল করে আর কি! ভীষণ অবস্থা । ডাক্তার এল। নার্স এল। অক্সিজেন গ্যাস এল । জামাইবাবু ছু'রাত ঘুমোলে। না । অনেক কষ্টে, অনেক অর্থবায়ে, ডাক্তার সান্তালের অনেক চেষ্টায় সে- যাত্র। টিকে গেল মিষ্টিদদি। কিন্ত জামাইবাবু আর দায়িত্ব নিলে না। শেষকালে কী হতে কী সবনাশ হয়ে যাবে ! মিষ্টিদিদি সেরে ওঠার পর জামাইবাবু বললে, 'শঙ্করকে আমি দেরাছুনে পাঠিয়ে দিই, কী বলো? ওখানে ওরা ট্রেনিংটা! ভালে দেয়। আর ওরা যত্বুও করে খুব ছোট ছোট ছেলেপিলেদের |, মিষ্টিদিদি ছলছল চোখে বললে, “কী কপাল দেখো আমার, নিজের ছেলেকে পর্যন্ত কাছে রাখতে পারবো না, আদর করতে পারবো না! তাতে কী হয়েছে, তুমি সেরে উঠলেই--” মিষ্টিদিদি বলতো, "আর সেরেছি, বেশি দিন আর নেই আমার বুঝতে কন্তাপক্ষ ৪২ পারছি, বড় জোর দিন পনরো--তারপর আমি মরে গেলে..., ওকে কিন্তু তুমি বাড়িতে নিয়ে এসে তোমার কাছে কাছেই রেখো.” | তারপর কত পনরো দিন কেটে গেছে, পনরো। বছর কাটতে চললো, কিন্তু কিছুই হয়নি মিষ্টিদিদির। প্লেট-প্লেট মাংস খেয়েছে, বাটি-বাটি আমড়ার অন্বল খেয়েছে, ঝাল ড'টা-চচ্চড়ি খেয়েছে, পোনা মাছের কালিয়া খেয়েছে । দামী দামী বিস্কুট কেকৃ লজেঞ্জ খেয়েছে, দামী দামী গাড়ি চড়েছে! মিষ্টিদিদির শোবার ঘর এয়ার-কণ্ডিশন্ড করা হয়েছে। ওষুধ, বিশ্রাম, আরাম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সব যুগিয়েছে জামাউ- বাবু। তবু অন্ুখ সারেনি মিষ্টিদিদির। অথচ কত সাবধানতা, কত সতর্কতা মিষ্টিদিদির জীবনের জন্যে । পাশের গাছের ডালে একটা কাক পর্যন্ত ডাকলে বুক ধড়ফড় করতো মিষ্টি'দদির ! হা-হী করে তাড়িয়ে দিতে হত। ঝড়বৃষ্টির দিনে যদি জোরে মেঘ ডেকে উঠতে। তো আপিস থেকে টেলিফোনে খবর নিতো জামাইবাবু_মিষ্টি কেমন আছে। খবরের কাগজট। আগে নিজে পড়ে তবে জামাইবাবু পড়তে দিতো মিষ্টিদিদিকে। অনেক খুন-জখমের খবর থাকে ওতে । সে-সব পড়ে যে- কোন মুহুর্তে হাট-ফেল হতে পারে । কতবার কত প্রমোশনের স্থযোগ এল জামাইবাবুর। এমন সচরাচর আসে না কারোর । উড়িষ্যার ময়ুরভঙ্জে গেলে মাইনে হত পাঁচ হাজার টাকা । ওখানকার মাটির তলায় খনির সম্বন্ধে গবেষণা করতে জামাইবাবুকেই পাঠানো ঠিক করলো ইত্ডিয়! গবনমেন্ট। মাইনে ছাড়। টি-এ আছে অনেক। কিন্ত প্রত্যেকবার মিষ্টিদিদি বলেছে, “আর ছু'টো। দিন আমার জন্যে সবুর করো, আর বেশিদিন কষ্ট দেব ন। তোমাদের ।, অপ্রস্তুত হয়ে গেছে জামাইবাবু । “আর ছূ'টে৷ দিন, শুধু ছুদিন, তার পরে তোমাকে আমি মুক্তি দিয়ে যাব_-তখন তুমি যেখানে খুশি যেয়ো), এ-সব আজ থেকে প্রায় পনরে। বিশ বছর আগেকার ঘটনা । কিন্তু সেই অল্প বয়সেও আমার যেন কেমন সন্দেহ হয়েছে, এ ধাগ্নাবাজি ছাড়া ৪৩ | কন্যাপক্ষ আর কিছু নয়। বড় স্বার্থপর মনে হয়েছে মিষ্টিদিদিকে। এই আরাম, এই বিশ্রাম, এই অর্থ-অপচয় ,এই বিলাসিতা থেকে পাছে বঞ্চিত হয়, পাছে পরিশ্রম করতে হয় মিষ্টিদিদিকে_-তাই যেন এই ছলন।। শঙ্কর যখন পুজোর আর গরমের ছুটিতে আসতো বাড়িতে, জামাইবাবু যেন কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতো । বলতো, “ওদিকে যেয়ো না শঙ্কর, তোমার মার শরীর খারাপ, জানো তো-' শঙ্করও যেন কেমন বিব্রত হত। ও-বয়সের ছেলেদের স্বাভাবিক ধর্ম হৈ-চৈ করা, খেলা, চিৎকার করা । কিন্তু পদে পদে বাধ। পেয়ে পেয়ে কেমন যেন জিয়মাঁণ হয়ে গিয়েছিল শেষকালে । যেন কলকাতায় আসতে ভাল লাগত না তার। আবার স্কুলে ফিরে যাবার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠতো । কেবল বলতো, “কবে যে ছুটি ফুরোবে ! মনে আছে একবার বলেছিল, “এখানে আমার বড় মন-মরা লাগে, ভালো লাগে না মোটে ।' কেন !; শহ্কর বলেছিল, “কী জানি । আপন যারা, তার! এত কম বয়সে পর হয়ে যায় কেমন করে ত1 ভেবে আমারও আবাক্‌ লাগতো । আমারও ম! ছিল। যখন ছুটিতে বাড়ি গেছি, সে অন্যরকম । আমাকে আদর করবার জন্যে কতরকম আয়োজন--কত রান্না, কত কী উৎসব আনন্দ হত। আর এ-ও তো মিষ্টিদিদ্ির ছেলে। বড়লোকের ছেলে! আরে। আনন্দ হওয়া উচিত বৈকি। কিন্ত হঠাৎ যদি কখনও ভূলে হে। হো! করে হেসে উঠতো, কোথা থেকে ঝি এসে বলতো, গুপ করে। খোকাবাবু, মার বুক কেমন করছে ।, মায়ের ঘরের দিকে অন্যমনস্ক হয়ে যদি শঙ্কর কোনদিন ঢুকে পড়তো, অম্নি দশজন ঝি-চাকর ই! হা করে উঠতো, এদিকে না__-এদিকে না, বাড়িটা যেন হাসপাতাল । অথচ যে রোগী সে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, খায়- দায়, সাজ-পোশাক করে। মিষ্টিদিদি বিকেলবেলা আসান করে। স্নানের কন্াপক্ষ 88 শেষে এসে বসে আয়নার সামনে । ছু'জন ঝি আসে এগিয়ে । তখন বেরোয় রুজ, লিপস্টিক, তেল, সেণ্ট, পাউডার-_- আরে কত কি! ভালে। ভালে। পোশাকী শাড়ি বেরোয়। ব্লাউজ বেরোয়। আলতা বেরোয়। একঘণ্টা ধরে সাজিয়ে-গুজিয়ে ফিটফাট করে দেয়। তারপর ইজি-চেয়ারট। বারান্দার সামনে রেলিং-এর গ! ঘেষে রাখা হয়। সেই সাজ, সেই পোশাক ক'রে মিষ্টিদিদি গিয়ে তখন আস্তে আস্তে বসে ইজি-চেয়ারে। কোনে কথা নেই, কোনে কাজ নেই-_ শুধু বসে থাকা, আলস্তের ঢেউ-এ গা এলিয়ে দেওয়।। এত আলম্ত যে কী করে সহ্য করে মিষ্টিদির্দি কে জানে। কিন্তু সবাই ভাবতুম-আর তো মাত্র ছু'টে৷ দিন, হয়ত আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা তারপরেই তো শেষ ! ছুটির সময় দেশে গেলে ম! সব শুনে বলতো, “ও মেয়ে মনোহরদাকেও অম্নি করে জবালিয়েছে, ও পটলকেও জ্বালিয়ে ছাড়বে, দেখিস ।, কিন্ত জামাইবাবুর অদ্ভুত ধৈর্য । স্ত্রীর জন্যে হাসিমুখে এমন আথিক, শারীরিক, মানসিক ক্ষতি স্বীকার করতে আর কাউকে দেখিনি আমি । অথচ স্ত্রেন বলবে। কেমন করে! কোথায় যেন মিষ্টিদিদির বাবহারে কিংবা চেহারায় একট? যাছু ছিল । রোজই সকালবেলা! জামাইবাবু একবার করে মিষ্রিদিদিকে জিগ্যেস করতো, 'আজ কী খাবে তুমি? কী খেতে ইচ্ছে করছে তোমার ? মিষ্টিদিদি কোনোদিন বলতো, "আজকে ফাউল আনতে বলে দাও ঠাকুরকে-__, কোনোদিন বলতো, “আজ মাটন্-_১ আবার কোনোদিন বলতো, 'আজ টোস্ট আর ফাউল কাটলেট করতে বলো ঠাকুরকে ।' কোনো-কোনো দিন আবার বলতো, চিলে। আজ হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসি, বাড়ির রান্না আর ভালে। লাগছে ন1।, এমন কোনোদিন হল না যেদিন মিষ্টিদিদি বলেছে,_-আজ শরীরটা খারাপ, কিছু খাবো না।, 8৫ কন্তাপক্ষ জামাইবাবু যদি কোনদিন বলতো, “এত শীতে আর না-ই বা বেরোলে, যদি ঠাণ্ডা লেগে যায় 1 মিষ্টিদিদি বলতো, “আর তো! মাত্র ক'টা দিন-_-যে ক'দিন বাঁচি করে নিই ।, তা এসব হলে পনরো। বিশ বছর আগের ঘটন। । মিষ্টিদিদির বাড়িতে থেকে আই. এ. পাস করেছি, বি, এ পাস করেছি _-এম. এ. পাস করেছি । করে চাঁকরি-স্থত্রে তখন বিলাসপুরে আছি। খবর পেয়েছিলাম, মিষ্টিদিদি তখন বেঁচে আছে । একদিনের জন্যেও কখনও জ্বর হতে শুনিনি, একদিনও উপোস করতে শুনিনি । আর শুনেছি মিষ্টি- দিদির জন্যে জামাইবাবু নিজের প্রমোশন, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সমস্ত ত্যাগ করে হাঙ্গারফোর্ড স্বীটের বাড়িতেই আছে । কিন্তু হঠাৎ মা”র চিঠিতে সেবার জামাইবাবুর মৃত্যুর খবর শুনে চম্‌কে উঠেছিলাম । জামাইবাবুর তো৷ কখনও অস্ুখ হতে দেখিনি । সে-মান্ুষ এমন হঠাৎ মারা গেল ! জর নয়, রোগশয্যায় দীর্ঘদিন পড়ে থাক নয়, হঠাৎ নাকি হাঁট-ফেল করেছে । কিন্তু ভয়ও হয়েছিল মিষ্রিদিদির জন্মে । মিষ্টিদিদি এশোক কেমন করে সহ্য করবে কে জানে! জামাইবাবু মৃত্যুর খবর শোন। মাত্রই তো মিষ্টিদিদির হার্ট-ফেল করার কথা ! সমবেদন। জানিয়ে মিষ্টিদিদিকে একট। চিঠিও দিয়েছিলাম মনে আছে। কিন্ত সে-চিঠির কোনে। উত্তর পাইনি বহুদিন। সেবার যখন কলকাতায় এলাম, দেখ করলাম গিয়ে । ঠিক সেইরকম ইজি-চেয়ারে মিষ্টিদিদি বসে । রুজ, পাউডার, লিপস্টিক, সিক্ব, সেন্ট, সাবান, ওঘুধ--কোনো। কিছুরই ব্যতিক্রম নেই। পাশেই ঘনিষ্ঠ হয়ে ডাক্তার সান্যাল বসে ছিলেন। ডাক্তার সান্তাল বলেছিলেন, অনেক কষ্টে তোমার মিষ্িদিদিকে বাচিয়ে রেখেছি । খুব শক্‌ পেয়েছিলেন, তিন দিন সেন্স ছিল না একেবারে ।' কন্তাপক্ষ ৪৬ বললাম, “শঙ্কর কোথায়? শুনলাম সে নাকি কলকাতায় ফিরে এসেছে? ডাক্তার সান্যাল বললেন, “এই তো! বেরোল যেন কোথায়, তাকেও বারণ করেছি বেশি কাছে আসতে--এত উইক হার্ট, কোনো এক্সাইটমেণ্ট সহা হবে না_-কনস্টাণ্ট কেয়ার নিতে হচ্ছে।' মিষ্টিদিদি বলেছিল, চলে! একটু গঙ্গার ধারে হাওয়৷ খেয়ে আসি। গাড়িটা বার করতে বলে |, ডাক্তার সান্যাল আপত্তি করলেন, «এ অবস্থায় যাওয়া ঠিক নয় আপনার --উইক হাট নিয়ে; মিঠরিদিদি উঠলে।। বললে, “আর তো! ছ্'টে। দিন-_ছু'টো৷ দিন হয়ত মোটে বখশচবো- সার! জীবনই তো ভূগছি, এখন আর ভালে লাগে না য। হয় হবে মনে আছে, যে ছু*দিন ছিলাম হাঙ্গারফোর্ড ্বীটে, ডাক্তার সান্যাল দিনরাত মিষ্টিদিদির পাঁশে পাশে থাকতেন ! কিন্তু আমার যেন কেমন ভাল লাগত না৷ মিষ্টিদিদির পোশাক-পরিচ্ছদেও তখন কোনে পরিবর্তন দেখিনি। শাড়ি, গয়না, সিক্ক, সেন্ট _-তা-ও পুরোমাত্রায় রয়েছে । একবার মনে হল, হয়ত স্বাস্থ্যের জন্তেই ও-সব পরেছে । হঠাৎ বৈধব্যের সাজ পরলে হয়ত জামাইবাবুর কথা বেশি করে মনে পড়ে যাবে । সঙ্গে সঙ্গে শক্‌ লাগবে হাটে। হয়ত সেইজন্যেই । হয়ত সেইজন্যেই জাঁমাইবাবুর মস্ত অয়েল পেটিংখানাও হল্‌ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সে রাত্রে মিষ্রিদিদির বাড়িতেই ছিলাম । শঙ্কর এল সন্ধ্যের পর। আমাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছে । বললে, “ছোট-মামা, তুমি-+ বললাম, “কোথায় ছিলি এতক্ষণ ?, “কোথাও না-- “সেই ছুপুরবেল। বেরিয়েছিলি, আর এলি এখন--এতক্ষণ কী করছিলি? শঙ্কর যেন আগের চেয়ে অনেক গন্ভীর হয়ে গেছে দেখেছিলাম । বলেছিল, “কিছু ভালো লাগছিল না, চৌরঙ্গীর ধারে মাঠে গিয়ে একটা বেঞ্চির ওপর শুয়ে ছিলাম একলা-একল 11, | ্ কন্ঠাপক্ষ এ বয়সের ছেলের পক্ষে এমন করে সময় কাটানো কেমন যেন অস্বাভাবিক | বললাম, “আজকাল খেলাধুলে! করিস তুই ? সেই টেনিস খেলা কেমন চলছে তোর ? 'এখানে এসে পর্যন্ত ও-সব ছু'ইনি, ছোট-মাম] 1, সেদিন খাবার টেবিলে ডাক্তার সান্ালও আমাদের সঙ্গে বসেছিলেন মনে আছে। মিগ্িদিদির পাশেই তার চেয়ার। ডাক্তার পাশে বস৷ দরকার। কখন মিষ্টিদিদির কি বিপদ হয় ! শঙ্কর চুপচাঁপ দূরে বসে খাচ্ছিল। মিষ্টিদিদি একবার বললে, ঠাকুর, তোমার বুদ্ধি তো বেশ, খোকাঁকে অত গুচ্ছের মাংস দিয়েছ কেন শুনি ?, শঙ্কর অন্যমনস্ক হয়ে খাচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলে বললে, “আমাকে বলছ, ম1 ? হ্যা, তোমাকেই তো বলছি। অত খাও কেন, খাওয়াটা হবে লাইট্‌ পেটে চাপ যেন না পড়ে_ঠাকুর না হয় ইডিয়ট্‌, কিন্তু তুমি তো। লেখাপড়া শিখেছ-__তোমাদের স্কুলে এতসব শেখায়, হাইজিন শেখায় না? ডাক্তার সান্যাল বললেন, আপনি অত উত্তেজিত হবেন না, মিসেস সেন।” মাছের একটা মুড়ো চুষতে চুষতে মিষ্টিদিদি বললে, “আমি আর ক'দিন ডাক্তার সান্তাল ! কিন্তু ছোট ছেলের! যদি এই বয়সেই স্বাস্থ্যের গোড়ার কথাগুলো না শেখে তো। কবে শিখবে ?? ডাক্তার সান্যাল বললেন, আমি আপনাকে বার বার তো বলেছি মিসেস সেন, এই সব সাংসারিক খুটিনাটি সম্বন্ধে মোটে ভাববেন না, ওতে আপনার হার্ট আরও উইক হয়ে যাবে ।, মিষ্টিদিদি ডাটা-চচ্চড়ি চিবোতে চিবোতে বললেন, ঠাকুর, আজকে চচ্চড়িতে ঝাল দিতে ভুলে গেছ তুমি |, ঠাকুর দাড়িয়ে ছিল পেছনে । বললে, “কই, ঝাল তে দিয়েছি, মা।, ছাই ঝাল দিয়েছ। ডাট'-চচ্চড়ি ঝাল না হলে খাওয়া যায় কন্তাপক্ষ রর তারপর আমাকে সাক্ষী মেনে মিষ্টিদিদি বললে, ্থ্যা রে, তুই-ই বল তো,- ঝাল হয়েছে চচ্চড়িতে ?” | বললাম, 'আমি তে। চচ্চড়ি খাইনি ।, “কেন? তুই চচ্চড়ি খাস না? ঠাকুর বললে, “ওটা শুধু আপনার জন্যেই করেছিলাম, মা) মিষ্টিদিদির গলা একটু চড়ে উঠলো, “কেন? শুধু আমার জন্যে কেন? তুমি বুঝি আমাকে খাইয়ে খাইয়ে মেরে ফেলতে চাও ! আমি মরে গেলেই তোমরা সবাই ঝচোঁ, না ? ঠাকুর রীতিমতে। অপ্রস্তুত। শঙ্করও দেখলাম খাওয়া বন্ধ করে মুখ নিচু করে আছে । আমিও কম অপ্রস্তুত হলুম মাঁ। আমাকে চচ্চড়ি ন দেওয়াতেই তো। এই কাণ্ড! মিষ্টিদিদি বললে, “আমার যেমন কপাল-_যাঁর হার্ট দুর্বল তার যে কেন বেচে থাক। !, তারপর মাংসর বাটিটা শেষ করে বললে, অথচ যার থাকবার কথা তিনি কেমন টপ. করে চলে গেলেন, আর আমিই কেবল মরতে পড়ে রইলুম !, ডাক্তার সান্ঠাল মিষ্টিদিদির মুখের কাছে মুখ এনে বললেন, আঃ আমি বার বার আপনাকে বলেছি না মিসেস সেন, ওসব কথা মোটে মনে আনবেন না, ওতে মিছিমিছি হুর্বল হা্টকে আরো ছুর্বল করা তারপর ঠাকুরকে বললেন, “তুমি এখান থেকে যাও তো ঠাকুর, আর আমাদের কিছু দরকার নেই ! তোমরা সবাই মিলে দেখছি ওর রোগটাকে বাড়িয়ে দেবে কেবল ।, খানিক পরে আমার কানে কানে বললেন, শিঙ্করকে নিয়ে তুমি চুপি চুপি টেবিল থেকে উঠে যাও তো, দেখছি তোমার মিষ্টিদিদি এক্‌সাইটেড হতে সুরু করেছে--যাঁও শিগগির-” তখনও খাওয়া শেষ হয়নি আমার । শঙ্করেরও খাওয়া শেষ হয়নি । কিন্তু মিষ্টিদিদির মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম তার পাতলা শরীরে যেন ৪৯ কন্তাপক্ষ আগুন জ্বলছে, কান ছুটে! ঠিক যেন করমচার মতন লাল হয়ে উঠেছে । সত্যিই বোধহয় হার্টের প্যালপিটেশন হলে ওই রকম হয় । সেদিন নিঃশবে শঙ্করকে নিয়ে উঠে এসেছিলাম খাবার টেবিল থেকে, মনে আছে। মনে আছে, পরে ডাক্তার সান্যাল বলেছিলেন, “মিস্টার সেন-এর শোকটা উনি এখনও ভুলতে পারছেন না কিনা_ওইটেই দিনরাত ভোলাবার চেষ্টা করছি-_দেখছ না, মিস্টার সেন-এর অয়েল পের্টিংখান। পর্যন্ত তাই সরিয়ে ফেলেছি ঘর থেকে ।, আর একদিন বলেছিলেন, “প্রা তো ছিলেন আইডিয়াল হাসব্যাণ্- ওয়াইফ তাই শৌকটা অত লেগেছে মিসেস সেন-এর । উনি তো মাছ- মাংস খাওয়াই ছেড়ে দ্িয়েছিলেন। আমি দেখলুম এই স্বাস্থ্যের ওপর যদি আবার খাওয়া-দাওয়ার অত্যাচার চলে তাহলে তো আর বাচাতে পারবে। না আমি। শেষে অনেক বুঝিয়ে-ম্বজিয়ে তবে যে-ক'দিন হাঙ্গারফোর্ড স্টীটে ছিলাম, সে-ক"দিন কেবল মনে পড়তে! জামাইবাবুর কথা! সত্যিই তো, তার তো যাবার কথা নয় এত শিগগির। কিন্তু এক-একবার মনে হত জামাইবাবু মরে গিয়ে বোধ হয় বেঁচেছেন । শঙ্কর আর আমি এক ঘরে, এক বিছানায় শুতাম। অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গিয়ে মনে হত যেন পাশে উসখুস করছে শঙ্কর । ডাকতাম, "শঙ্কর !, ৬ 1১ ৫১৬, "| “ঘুমোসনি এখনও ? "ঘুম আসছে ন। যে, ছোট-মাম11, “কেন ঘুম আসছে না রে, ছুপুরবেল! ঘুমিয়েছিলি বুঝি ?? না, কোনও দিন রাত্তিরে ঘুম আসে না আমার ।, কেন? “কী জানি।' ৪ কন্ঠাপক্ষ ৫৬ বারে। বছরের শঙ্কর সেদিন তার ঘুম নাআসার কোনো কারণ বলতে পারেনি। আমিও যেন কারণট। পুরোপুরি বুঝতে পারিনি সেদিন । একবার ডাক্তার সান্যাল মিট্রিদিদির জন্মোৎসব অনুষ্ঠান করেছিলেন মনে আছে। | মিষ্টিদর্দি বলেছিল, 'আমার আবার জন্মদিন কেন? আর ক'দিনই বা বাচবে। ॥ ডাক্তার সান্যাল বলেছিলেন, আপনার জন্মদিনট। তো৷ একট! উপলক্ষ্য, মিসেস সেন। লক্ষ্য, আপনাকে একটু আশা দেওয়া, আপনার জীবনট। যে মূল্যবান এইটে মনে করিয়ে দেওয়া । আপনি যেন এতে আপত্তি করবেন না, মিসেস সেন।, মিষ্টিদদি বলেছিল, “কিন্ত আমি কি অত হৈ-চৈ গোলমাল উত্তেজন! সহা করতে পারবো ? আমার হার্টের যা, ডাক্তার সান্যাল বলেছিলেন, “আমি তো। আছি, মিসেস সেন, ভয় কি ? আপনার দীর্ঘ-জীবনের কামনা নিয়েই তো এই উৎসব। সংসারের খু'টিনাটি থেকে মনকে কিছুক্ষণের জন্যে দূরে সরিয়ে রাখা-এতে হাট বরং ভালোই হবে, আমি বলছি । আপনি কোনে “কিন্ত' করবেন না, আপনি যেমন রোজ ইজি-চেয়ারটায় বসে থাকেন তেমনি বসে থাকবেন শুধুঃ আমরা পাচজনে আপনার দীর্ঘ পরমায়ু কামন। করবো ।, তা হলও তাই। ফুলের তোড়া দিয়ে সাজিয়ে দেওয়। হল মিষ্টিদিদির ঘর। বিছানা, ফানিচার, ড্রেসিং টেবিল-_যেদিকে মিষ্িদিদির চোখ পড়তে পারে, সবদিকে শুধু ফুল আর ফুল। শান্ত গন্ভতীর পরিবেশের মধ্যে পালিত হয়েছিল মি্রিদিদির সেই প্রথম জন্মোৎসব । মিষ্টিদিদি যেমন করে সেজে- গুজে বসে থাকতে! সেদিনও তেমনি করেই বসে ছিল। সন্ধ্যেবেলা শুধু আমর! তিনজন-_ আমি, শঙ্কর আর ডাক্তার সান্ত।ল আমাদের উপহারগুলে। সামনের তেপাঁয়া টেবিলের ওপর গিয়ে রেখেছিলাম । ডাক্তার সান্যাল দিয়েছিলেন দামী হীরে সেট্-করা! একটা ব্রোচ। এখন মনে হয়, সে- জিনিসের দাম তখন ছিল খুব কম করেও আট ন'শো টাকা। ১ কন্ঠাপক্ষ মিষরিদিদি দেখে বলেছিল, “এত দাঁমী জিনিস কেন দিলেন আমাকে-_- আমি আর ক'দিনই বা পরতে পারবে এ-সব !, ডাক্তার সান্যাল বলেছিলেন, “ওইসব কথা দয়! করে আজকের দিনে আর মুখে আনবেন না, মিসেস সেন ।? আমি আর শঙ্কর দিয়েছিলাম নিউমার্কেট থেকে কেন রজনীগন্ধার ছু'টে। ঝাড় । মিট্রিদিদি দেখে বলেছিল, “ফুলই আমার পক্ষে ভালে রে-_ফুলের মতোই ছু'দিন শুধু আমার পরমায়ু। বলতে বলতে কেমন করুণ হয়ে উঠেছিল মিষ্টিদদির চোখ । পাতলা শরীর যেন থরথর করে কেঁপে উঠেছিল একটু । কিন্তু ডাক্তার সান্যাল ছিলেন, তাই খুব সামলে নিয়েছিলেন সেদিন । তাড়াতাড়ি ম্মেলিং সন্ট-এর শিশিট! মিষ্টিদিদির নাকের কাছে নিয়ে আমাদের বলেছিলেন, যাও শঙ্কর--তোঁমরা এখান থেকে শিগগির চলে যাও! মিসেস সেনের অবস্থা যা দেখছি-__+ মিষ্টিদিদির সেই প্রথম জন্মদিনের অনুষ্ঠানট। সেদিন সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রতি বছর যেখানেই থাকি, মিষ্টিদদির জন্মদিনে কখনও চিঠি, কখনও টেলিগ্রাম গেছে আমার কাছে । আর প্রত্যেকবারই আমি এসেছি । কিন্তু ভুলেও কখনো ফুল উপহার দিইনি । ফুল মিষ্টিদিদির ত্রিসীমানায় ঘে'ষতে পারতো না। ফুল দেখলেই নাকি তার মনে পড়তো, ফুলের মতোই তার ক্ষণস্থায়ী জীবন-__ফুলের মতোই তার পরমায়ু ক্ষণিক। ও কথাট। মনে পড়া হার্ট-ডিজিজের রোগীদের পক্ষে তো! মারাত্বক | মিষ্টিদিদির জন্মোৎসব প্রত্যেক বছরেই হত। শুধু মাঝখানে বছর ছুই বন্ধ ছিল। সে-সময় ডাক্তার সান্যাল মিষ্টিদিদিকে নিয়ে ভিয়েনা গিয়ে- ছিলেন চিকিৎস। করাতে । মিষ্টিদিদি নাকি প্রথমে রাজী হয়নি । বলেছিল, 'আর তো কণ্টা দিন স্প্তার জন্যে কেন মিছিমিছি কষ্ট করা |: ডাক্তার সান্যাল বলেছিলেন, “তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবো আমি |, কন্তাপক্ষ ৫২ আমি তখন স্থান থেকে স্থানাস্তরে বদলি হয়ে চলেছি । কোনে খবর রাখতে পারিনি মিষ্টিদিদির। বিলাসপুর থেকে যাচ্ছি জববলপুরে ৷ জব্বল- পুর থেকে নাইনিতে। নাইনি থেকে এলাহাবাদে। শুনেছিলাম হাঙ্গার- ফোর্ড স্টীটের বাড়িতে শঙ্কর থাকতো। একলা । কেমন যেন মায়া হত ওর কথা ভেবে। জন্মের পর থেকে বাপমায়ের প্রত্যক্ষ নেহ ভোগ করবার অবকাঁশ হয়নি জীবনে । নিঃসঙ্গ নির্ভরহান শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে তখন সবে পা দিয়েছে শঙ্কর । মনে হত, এবার শঙ্করের একটা বিয়ে দিলে ভালো হয়! কিন্ত কে দেবে? সেবারে কথাট। পেড়েছিলাম মিষ্টিদিদির কাছে। বলেছিলাম, “এবার শঙ্করের একটা! বিয়ে দিয়ে দাও, মিষ্টিদিদি । মিষ্টিদিদি বলেছিল, “আর ক'ট। দ্বিন, তারপরেই তো! আমার ইহলীল। শেষ। তখন সবাইকে ছুটি দিয়ে যাবো আমি, শঙ্করও বিয়ে-থা করে স্তুখে থাকতে পারবে। আর ছু'টে। দিন আমার জন্যে ও সবুর করতে পারবে নাঁ_ ভিয়েন৷ থেকে ফিরে আসার পর যেবার মিষ্িদিদির জন্মদিনে আবার নিমন্ত্রণ হল, সেবার ভেবেছিলাম স্বাস্থ্য বোধ হয় ফিরেছে মিষিদিদির | কিন্তু গিয়ে দেখলাম, সেই একই অবস্থা । তেমনি ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আগেকার মতো । আমার আনা উপহারট। সামনের টেবিলে রেখে জিগ্যেস করেছিলাম, “কেমন আছ, মিষ্টিদিদি ? মিষ্টিদিদি তেমনি সিঙ্ব, সার্টিন, জর্জেট, স্নো, পাঁউডারে মুড়ে বসে ছিল । বললে, “আমার আর থাকা_-আর বোধ হয় বেশিদিন নয়--! বললাম, “বাইরে গিয়েও সারলে। না শরীর ? মিষ্টিদির্দি বললে, “এ মরবার আগে আর(সারছে ন। রে !; বলে চকোলেট চুষতে লাগলে! । কিন্তু শরীর সারাবার জন্যে মিষ্টিদিদির চেষ্টারও তা বলে অন্ত ছিল ন।। ডাক্তার সান্যাল মিষ্টিদিদিকে নান জায়গায় ঘুরিয়ে আনতেন। কখনও পুরী, ৫৩ কন্ঠাপক্ষ কখনও চিল্কা, কখনও অন্য কোথাও । ডাক্তার সান্যাল কবে একদিন চিকিৎসা করতে এসেছিলেন মিষ্টিদিদিকে। সে কোন্‌ যুগে। জামাইবাবু তখন বেঁচে। তাঁরপর কতদিন কেটে গেল । রোগও সারলে! না৷ মিষ্টিদিদির, আর ভাক্তার সান্যালও গুরু দায়িত্ব থেকে বুঝি মুক্তি পেলেন না । হঠাৎ সেবার শঙ্করের আত্মহত্যার খবর পেয়ে মনে আছে দৌড়ে এসে- ছিলাম কলকাতায় । এমন আকম্মিকভাবে ঘটনাটা! ঘটলো, যেন বিশ্বাসই করতে পারিনি প্রথমে । ভয় হয়েছিল এবার আর মিষ্রিদিদিকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। শঙ্করের এমন শোকে নিশ্চয়ই মিষ্রিদিদি হার্ট-ফেল করবে । সেবার জামাই- বাবুর শোক মিষ্রিদিদি যদিও বা ভুলতে পেরেছে ডাক্তার সান্যালের চেষ্টায়, শঙ্করের অপমৃত্যুর আঘাত নিশ্চয়ই অসহ্য হয়ে উঠবে ! হয়ত গিয়ে দেখবে শঙ্কর তে! নেই-ই, মিষ্টিদিদিও বেঁচে নেই আর। অত্যন্ত ভয়ে হাঙ্গারফোর্ড স্টীটের বাড়িতে এসে পৌছলাম। শন্করের এমন পরিণতি হবে ভাবতেই পারিনি । একবার ভেবেছিলাম শঙ্কর হয়ত মিষ্টিদিদিকে আঘাত দ্রেবার জন্যেই এই পথ বেছে নিয়েছে । হয়ত শস্কর ভেবেছিল, এই ভাবেই একমাত্র মিষিদিদির ওপর প্রতিশোধ নেওয়। যায়। কিন্ত শহ্কর তো৷ জানতো ন! মিগ্রিদিদির লোহার হার্ট । ভেতরে ঢোকবার রাস্তাতেই বাইরের ঘরে ডাক্তার সান্যাল বসেছিলেন। বললেন, “এসেছ তুমি-__শুনেছ বোধ হয় খবরট।-_?, বললাম, "শঙ্কর কেন এমন করলে! ? কী হয়েছিল? ডাক্তার সান্যাল সে-বুত্তান্ত বললেন। বরাবর নির্বাক নিধিরোঁধ শঙ্কর, মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাকি । মনে আছে ডাক্তার সান্তাল বলে- ছিলেন, “যদি আুইসাইড না করতো শঙ্কর তো নিশ্চয় পাগল হয়ে যেত 'শেষকালে- দেখতে-+ বললাম, “মাথা-খারাপই বা হল কেন ? ডাক্তার সান্যাল বললেন, “ডাক্তারী শাস্ত্রে একে বলে “মেনিয়া' । বেশি বন্যা পক্ষ ৫৪ ক্রডিং নেচারের লোক হলে এ-রকম হয়। হয় সুইসাইড ।করে, নয়তো পাগল হয়ে যায় শেষ পর্যস্ত ।? তারপর বললেন, “তামার মিষ্িদিদিকে যেন এ খবরটা বোলো ন। আবার। ওঁকে জানানো হয়নি এখনও ।, মিঠিদিদি জানে না? “না, জানানে। হয়নি, জানালে এ-যাত্রা আর বাঁচাতে পারতুম না । মিস্টার সেন-এর বেলায় জানি কিনা হাজার হোক মায়ের প্রাণ তো, ছেলের মৃত্যু কোনে মা-ই সহ্য করতে পারে না, তার ওপর মিসেস সেন- এর হার্ট-এর অবস্থা এখন আরও খারাপ, যে-কোনো দিন যে-কোনে। বিপদ ঘটতে পারে ।, সেদিন সি'ড়ি দিয়ে মিষ্রিদিদির ঘরে ওঠবার সময় মনে আছে আমার যেন খুন চেপে গিয়েছিল । মনে হয়েছিল, শঙ্করের অপমৃত্যুর খবরটা আমিই শোনাবো মিষ্টি- দিদিকে । দেখি পরখ করে মিষ্টিদিদির হার্ট-ফেল হয় কিনা! যদি হয়, তাতেও আমার দুঃখ নেই । মনে হয়েছিল--মিষ্িদিদির নাম কে রেখেছিল জানি না, কিন্তু মিষ্রিদিদির কোনখানটাই যেন আর মিষ্টি নয়। কিন্তু সমস্ত সঙ্কল্প আমার মিষ্টিদিদির সামনে গিয়ে ভেসে গেল। সেই সিক্ক, সেন্ট, জর্জেট, নৌ, পাউডার ! সেই ইজি-চেয়ার, সেই শরীর-খারাপের অভিযোগ । সেই চকোলেট চোষা । সেই ঝি-এর বসে বসে পায়ে হাত বুলোনো। সত্যিই, কিছু বলতে পারলাম ন৷ সামনে গিয়ে। মিষ্টিদিদি বললে, 'আর ক"টা দিন, তারপর তোদের সবাইকে মুক্তি দেব।” বলে চকোলেট চুষতে লাগলো মিষ্টিদিদি । হাঙ্গারফোর্ড স্টীট থেকে তার পরদিন দেশে গিয়েছিলাম । ম। বললে, শঙ্কর আমাদের সোনার টুকরো ছেলে তাই অপঘাতী হল, নইলে অন্য ছেলে হলে মাকেই খুন করতো । মনোহরদা বেঁচে থাকলে ও-মেয়েকে গুলি করে মারতো, দেখতিস ।; ৫৫ কন্তাপক্ষ বুঝতে পারলাম না। বললাম, “কেন ?' পতা না তো৷ কি, কোথায় ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ আনবে, তা। নয়, বিধবা মাগী বিয়ে করে বসলো । শঙ্কর কি সাধ করে অপঘাতী হয়েছে ভাবিস !, বললাম, “কে বিয়ে করেছে ? “ওই মিষ্টি, ডাক্তারকে বিয়ে করে বসলো। অত বড় ছেলে থাকতে !? তা এসব ঘটনাও প্রায় পনরে। বিশ পঁচিশ বছর আগেকার । তারপর প্রতি বছরেই মিষ্টিদিদির জন্মদিনটিতে কলকাতায় গেছি। উপহার দিয়ে এসেছি যথারীতি ! ডাক্তার সান্যাল প্রতিবারের মতে। মিষ্টিদিদির স্বাস্থ্যের জন্যে সতর্কতা নিয়েছেন-_-কোনে। উত্তেজন। ন! হয় কোনো অশান্তি না হয় মনে! তাহলেই মিষ্টিদিদিকে আর বীচানো যাবে না। ডাক্তার সান্যাল বার বার বলেছেন, মিষ্টিদিদির হার্টের যা অবস্থা তাতে যে-কোনো দিন যে-কোনো মুহুর্তে যে-কোনে। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে! কিন্তু গত পনরো বিশ পঁচিশ বছরে কত কোটি কোটি মুহুর্ত নিঃশবে মহাকালে গিয়ে লয় হয়েছে, কোনে। ছুর্ঘটনা ঘটেনি । তারপর যেবার ডাক্তার সান্যালেরও মৃত্যু-সংবাদ পেলাম, সেবারও ভালো করে জানতাম কিছুই ঘটবে ন। মি্িদিদির। বেশ জানতাম, মিষ্টিদিদির লোহার হার্ট । ভালে! করে জানতাম, মিষ্টিদিদি আর যাই হোক-মিষ্টি নয় মোটেই । তবু গেছি মিষ্রিদিদির বাড়ীতে । মিষ্টি- দিদির জন্মদিনের নিমন্ত্রণ আমি এড়াতে পারিনি কখনও । এই গত বছরেও আবার মি্টিদিদির জন্মদিনে কলকাতায় এসেছিলাম । ভালে। করেই জানতাম-_মিষ্রিদিদি তেমনি ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকবে । পায়ে সুভন্রড়ি 'দেবে ঝি। সিক্ষ, সেন্ট, জর্ভেট, সো, পাউডারে মুড়ে সেজেগুজে চুপ করে থাকবে । তেমনি প্রতিবারের মতোই উপহার দেব গিয়ে। রাখবো! গিয়ে তেপায়া টেবিলের ওপর । বলবে? “কেমন আছে মিষ্িদিদি। মিষ্টিদিদি তেমনি করেই বলবে, আমার আর থাকা, আর তো ছু'টে। দিন পরেই তোদের ছুটি দিয়ে যাবে। রে কন্তাপক্ষ ৫৬ বলে মিষ্রিদ্িদ্রি তেমনি করেই ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে চকোলেট চুষে আর আরামে গা এলিয়ে দেবে প্রতিবারের মতো । সত্যি, স্থষ্টিকত্া যেন মিষ্িদিদিকে অক্ষয় পরমায়ু দিয়ে পাঠিয়েছিল এ সংসারে। কিন্ত গতবারের জন্মদিনে মিষ্রিদিদি সত্যি সত্যিই আমায় অবাকৃ্‌ করে দিয়েছিল। হাঙ্গারফোর্ড স্টীটের বাড়িতে গিয়েও প্রথমে টের পাইনি। তেমনি চাঁকর-বাকর-ঝি-মালী সবই ছিল । কিন্তু সেই পরিচিত ইজি- চেয়ারটা খালি। একজন ঝিকে দেখতে পেয়ে জিগ্যেস করেছিলাম, “মিষ্টিদিদি কোথায় ?' ঝি বললে, “ঘরে শুয়ে আছেন- অস্তথখ করেছে । জিগ্যেস করলাম, 'অস্থখ কবে হল ? ঝি বললে, “কাল থেকে । হঠাৎ পড়ে গেছেন কাল ।, তা সত্যি অন্ুখ হয়েছিল মিষিদিদির। ঘরে গিয়ে দেখি চিত হয়ে শুয়ে আছে খাটের ওপর । সমস্ত দেহটা অসাড়। অনড়। ধরে পাশ ফেরাতে হয়। মুখ তুলে খাইয়ে দিতে হয়। সমস্ত অঙ্গ শিথিল হয়ে গেছে । প্যারালিসিসে একেবারে পন্থু করে দিয়েছে মিষ্টিদিদিকে। তবু তারই মধ্যে কেউ বুঝি পাউডার, স্ব, রুজ, লিপষ্টিক মাখিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে রেখেছে । পাঁয়ে কোনো সাড় নেই। তবু একজন ঝি পায়ে সুড়ম্ুডি দিচ্ছে নিচেয় বসে বসে। বরাবরের অভ্যেস মতো বলেছিলাম, কেমন আছ মিষ্টিদিদি ? মিষ্টিদিদি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল, কিছু কথা বলতে পারেনি ! শুধু ঠোঁট ছুটো যেন ঈবৎ নড়তে লাগলো । মনে হল যেন বলতে চাইছে,_ আমার আর থাকা-থাকি'".*আমার আর ক'ট। দিন.*'ক'টা দিন পরেই তোদের ছুটি দিয়ে যাবো...এবার সত্যি আর বেশিদিন নয় .. মষ্টিদিদির চোখ দিয়ে জল পড়ে পাউডার-স্মো ধুয়ে গেল ! মিট্রিদিদির চোখে সেই প্রথম জল দেখলাম জীবনে । কিন্তু তবু আমার মনে হয়েছিল-_ মিষ্টিদিদি যেন এখনও মিথ্যে কথা বলছে, ধাঞ্সা দিচ্ছে আমাদের-_-এ-ও নি কন্তাপক্ষ যেন ভান, এ-ও যেন মি্টিদিদ্রির নতুন একরকমের ছল। একেবারে না মরলে আর মিষ্টিদিদিকে যেন বিশ্বাস নেই । আজ ভাবি কোথায় গেল সেই মিষ্টিদিদি। আর কোথায় গেল সেই সোনাদি। লিখতে লিখতে আজকাল অনেক সময় অন্যমনস্ক হয়ে যাই । অনেক সময় তলিয়ে যাই নিজের ভাবনার সমুদ্রে । একদিন লেখক হতে পারবে! এ-কথা কি সেদিন ভাবতে পারতাম! লোলুপ নয়নে চেয়ে দেখেছি শুধু পরের বই-এর দিকে । ছাপা হয়েছে কত লোকের গল্প কত মাসিক- সাপ্তাহিকের পাতায়। কত লেখা পড়ে কাদতে কাদতে চোখ ফুলে উঠেছে । আর ক্ষোভ হয়েছে, ঈর্ষা হয়েছে মনে মনে কবে আমি এমন লেখা লিখতে পারবো । আমার লেখা পড়ে কবে এমনি করে অন্য পাঠকরা কাদবে, হাসবে, বিশ্বত্রক্ষাণ্ড ভূলে যাবে। কিন্তু কোথায় গেল সে-সব লেখা আর সে-সব লেখক। নিজে ভুলঠিকানার চিঠির মতন শুধু এক দেশ থেকে আর-এক দেশে ঘুরেছি । এক ঘাট থেকে জীবনের আর এক ঘাটে। দশটা স্কুল ছু'য়ে তবে স্কুলজীবনের শেষ পরীক্ষাটাই উৎরোতে পেরেছি । তখনো কি জানি শুধু স্কুলের পরীক্ষাটা শেষ পরীক্ষা নয়। জীবনের শেষ-পরীক্ষার চৌকাঠ পার হতে অক্লান্ত সাধনা চাই। কিন্তু সোনাদি না৷ জানালে সে-কথা কি আমিই জানতাম কোনে! দিন। তখনো শুধু জানি সম্পাদকের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেই লেখা ছাপানো যায়। প্রকাশকের আত্মীয় হলেই বই ছাপা হয়। অর্থবান হলেই পরমার্থ লাভ হয়। কিন্ত সোনাদি আমায় শেখালে জীবনের আর একট! দিকের কথা । সোনাদি-ই আমাকে প্রথম স্বীকার করলে বলা যায়। অথচ সোনাদির সঙ্গে পরিচয় সে-ও এক আকন্মিক ব্যাপার বৈকি। অমরেশ-ই তো আমায় প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলে । সেই অমরেশ ! অমরেশের গল্প বলার ক্ষেত্র এ নয়। “কম্তাপক্ষ'তে শুধু নারী-চরিত্রের দ্রিকটাই বলবে! ভেবেছি ! কিন্তু অমরেশের কথা! যেদিন লিখবো সেদিন কন্তাপক্ষ ৫৮ আমার সমস্ত কৃতজ্ঞত। উজাড় করে ঢেলে দ্রিতে হবে। অমরেশ নিজেও কোনদিন জানতে পারেনি আমার কী পরম উপকারটা সে করেছে। অমরেশই একদিন ঠাট্টা করে বলেছিল, “সোনাদি জানো, এ কবি-, সোনাদিও ঠাট্টা হিসেবে ধরেছিল প্রথমে । বলেছিল, 'পদ্ধ লিখিস বুঝি তুই ?, বললাম, “পঞ্চ নয় গল্প ॥ গল্প? শুনে সোনাদি কিন্ত হাসেনি ! অবাক্‌ হয়ে গিয়েছিল । আর কিছু বলেনি! কোথায় গেল .সেই অমরেশ। কোথায় গেল অমরেশের ক্লাবের অন্য সব বন্ধুরা । সোনাদির বাড়ির সামনে বাগানের এককোণে ছিল অমরেশের আখড়া । আমর। ছিলাম অমরেশের সাকরেদ। ডাম্বেল ভাজতুম, মুগ্ডর ঘোরাতুম। তারপর যথানিয়মে যখন ক্লাব ভেঙে গেল, সবাই ছিটকে গেল যে যার দিকে, আমিই শুধু রয়ে গেলাম টি'কে। সোনাদির সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েই গেল বরাবর । | সত্যি যদি কোনদিন আমার লেখক-জীবনের জন্মকথা৷ লিখি তো। সেদিন সোনাদির কথ। আগে লিখতে হবে। সোনাদি না হলে আমার লেখক- জীবনের অনেকখানিই যে বাদ পড়ে যেত। মফন্বলের একট গরীব ছেলেকে সোনাদি যে কী' দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিল কে জানে । অথচ সোনাদি আসলে আমার কে। কেউনা। আমার সমসাময়িক যারা তাদের এক-একখানা করে চোখের ওপর দশ-বারোখানা বই বেরিয়ে গেল। নাম-ধাম হল তাদের। আমার একখানাঁও বই নেই। সোনাদি বলতো, “তা না থাক্‌, আগে হাতটা ভালে করে পাকুক-_ তারপর'** এক-একটা গল্প লিখে নিয়ে পড়িয়ে শোনাতে যেতুম সোনাদিকে । বলতাম, “এবার হাত পেকেছে ?, সোনাদি বলতো, “না, এখনও ঢের দেরি__জাত-উপন্যাস লিখতে এখনে অনেক দেরি হবে তোর।” ডে কন্তাপক্ষ মনে আছে সেইসব ছৃপুরগুলোর কথা । চারিদিকে ঝণ ঝশ করছে রোদ্দর। সমস্ত কলকাতা খালি। রাস্তায় একট! ফেরিওয়ালাও নেই! একলা -একল! একটা সাইকেল নিয়ে চলেছি পত্রিকার অফিসে । গল্পটা কি তাদের পছন্দ হয়েছে! এ-পত্রিকার অফিস থেকে সে-অফিস! তারপর আর একটা অফিস। গ্রহ থেকে গ্রহাস্তরে, কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে । অশান্ত একটি ছেলে সারা কলকাতা সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে ৷ একটা। লেখা! ছাপা হোক, দশজনে ভালো বলুক । আমার খ্যাতি হোক ৷ আমার খ্যাতিতে আমার বংশের মুখ উজ্জল হোক । এইটুকু শুধু । আর কিছু কামনা নয়। সে-সব ছুপুরে সোনাদি ঠাণ্ডা ঘরের ভেতর বসে ইজি-চেয়ারে ভিজে চুল এলিয়ে দিয়েছে । হাতের বই-এর পাতাগুলো পাখার বাতাসে ফর্‌ ফর্‌ করে উড়ছে । আর বাইরের বাগানে আমগাছটার ডালে একটা কাদের ঘুড়ি এসে আটকে গেছে! বাগানের সবুজ পরিবেশে লাল-শীল রঙের ঘুড়িট৷ যেন একট বেখাগ্স। ছন্দপ্তনের মতন আটকে আছে । সোনাদির পাঁড়াটার জাতই আলাদী। সকাল-বিকেলেও নিরিবিলি । হাতে বাজারের থলি নিয়ে পথচারীর আনাগোনা বড় নেই। যা-কিছু শব্দ তা মোটরের। ওট1 বিশেষ করে মোটর-বিহারীদেরই পাড়া । আর আমি? আমি ওই আমগাছটার দোছুল্যমান ঘুঁড়িটার মতোই ও-বাড়িতে একমাত্র অতিথি । ক্ষণে অ-ক্ষণে ওখানে আমার গতি অবারিত শব্ধ পেয়ে সোনাদি জিগ্যেস করেছে, “কে রে “আমি- “ও, আয় বলে সোনাদি আবার ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়েছে । আবার ফিরে বলেছে, আর কী লিখলি--, সোনাদি জানতো লেখার কথা বলতে পেলে আমি আর কিছুই চাই না। লেখাই তখন আমার জপ তপ নিদিধ্যাসন। পকেট থেকে তাড়াতাড়ি কাগজ বেরিয়ে আসে তখুনি। পাচ-সাঁতট। গল্প আমার পকেটে আছেই। একট। বসবার জায়গা, একজন মনোযোগী শ্রোতা পেলেই আমি খুশি । আমি জীবন দেখবো । জীবন দেখাবো । যে-কথা লাজুক মুখচোরা মন কন্তাপক্ষ ৬ কাউকে বলতে পারে না, যে-কথা৷ একা-ঘরের চার-দেওয়ালের মধ্যে মাথা কোটে--আড্ডায়, সমাজে, সভায় বেরোতে আডষ্ট হয়ে যায়, সেইসব কথা সস্তা তিনটাকা দামের ব্ল্যাকবার্ড ফাউণ্টেন পেনের ডগায় কেমন অবলীলায় বেরিয়ে আসে । বলতে চায়,-আমি লাজুক হলেও সব বুঝি। আমাকে যতটা বোকা ভাবো আমি তা নই। আমি তোমাদেরও চিনি। যারা নিজেদের চেনো না, তাদের আমি চিনিয়ে দেব। যারা বোবা, তাদের আমি কথ। ফোটাবো। আমি শিল্পী। আমি সাহিত্যিক। সোনাদি-ই আমাকে একমাত্র ভালে। করে বুঝতে পারতো । বললাম, “ওরা ও-গল্পট। ছাঁপবে বলেছে, সোনাদি-- সোনাদি অবাকৃ্‌ হয়ে যেত। বলতো, “ছাপবে ? 'বা রে, কেন ছাপবে না, ওদের কাগজে যে-সব লেখা বেরোয় ভার থেকে তো ভালো গল্প হয়েছে, “তা হোকগে ভালো, সেই তারাই কি তোর আদর্শ! একদিন তোকে মহাভারত লিখতে হবে না? একদিন পৃথিবীর মানুষ আর পৃথিবীর জীবন নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না? কে কী ছাপলে। কী ছাপলে না, কার চেয়ে ভালে হল, এ-কথ। তুই ভাববি নাকি ? বললাম, আমি থাকি সেই কোথায়, গিয়ে খোঁজ-খবর না নিলে ওরা যে ফেলে রাখবে-_জানা-শোন। লোকদের লেখাই ছাপবে আগে", সোনাদি বলবে, “একদিন তোর কাছে সবাই ছুটে আসবে এমনি লেখা লিখতে চেষ্টা কর দিকিনি--যা কিছু দেখেছিস, দেখছিস, সব লিখে রাখ ; যা কিছু ভাবছিস, পড়ছিস, সব ট্ুকে রাখ- সেদিন কাজে লাগবে ।: তারপর হাতের বইটাকে পাশের টেবিলের ওপরে রেখে দিয়ে সোজা হয়ে বসতে। ৷ বলতো “মানুষকে আগে ভালে৷ করে চিনতে শেখ, কণ্টা মানুষকে দেখেছিস তুই, আর বয়েসই বা তোর কত-_যাদের সঙ্গে পাশাপাশি কাটিয়েছিস, একসঙ্গে দিনরাত একঘরে কাটাস, তাদেরই কি ভালো করে চিনিস বলে গর্ব করতে পারিস--এই যে এতদিন আমার সঙ্গে আলাপ ৬১ কন্তাপক্ষ তোর, কতদিন ছুপুরবেল। আমার কাছে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিস _-আঁমাকেই কি চিনতে পেরেছিস তুই ? হঠাৎ আমাকে ভাবিয়ে তুলতো। সোনাদি। সোনাদিকে কি চিনি! সোনাদির সবটুকুকে ! যে-মানুষটা এই ছুপুরবেল৷ চুল এলে! করে দিয়ে ইজি-চেয়ারে বসে আছে। যে-মান্ুবট! ধৈর্য ধরে আমার লেখাগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা শোনে । উৎসাহ দেয়, নিরুৎসাহ করে। কাছে টেনে নেয়, দূরে সরাতে দ্বিধা করে না। যে-মান্ুষটা বাইরে এত স্থির, ভেতরে এত অশান্ত । যে-মান্ুষট! বুদ্ধি, বিছ্ধে, ফ্যাশন, সমস্ত নিঃশেষ করে দিয়েছে একট জীবনে । যে সংসার করে, এ গৃহের গৃহিণী, অথচ এ-বাড়ীর কারে সত্রীনয়! যে-মান্ুষ একদিন নিজের সংসার, স্বামী পরিত্যাগ করে এসেছে এক সামান্য কারণে ! যে মানুষটা এতগুলে। সন্তান মানুষ করেছে, অথচ আইন মাফিক মা নয় এদের। যে-মানুষ পার্টি দেয়, সে-পার্টিতে নিমন্ত্রিত হবার গৌরবে যে-কোনো পুরুষ ব৷ স্ীলোক গৌরবান্বিত বোধ করে ! দাঁশসাহেব বলতেন, “আমাকে বল। মিথ্যে, ওসব সোনা-ই জানে-_ অভিলাষ ছিল দাশসাহেবের চাকর । চা নিয়ে এলে বলতেন, “এই তো! চ খেলাম, আবার কেন-_ অভিলাষ বলতো, “চা তো আপনি খাননি আজ-_” চটে উঠতেন দাঁশসাহেব, আলবত খেয়েছি । জিগ্যেস কর তোর মাকে সোনাদি এসে বলতো, “কী হল আবার-__; 'দেখো। তো। সোনা, অভিলাষ বার বার আমাকে চা খাইয়ে মারতে চায় __ব্রাডপ্রেসারট। কত করে কমাবার চেষ্টা করছি ছুটিতে ছেলেমেয়েরা বাড়িতে এসে কোনদিন বায়না ধরলে বলতেন, “আমাকে না--ওসব তোমরা মা-কে বলো! গিয়ে |, অফিসে গিয়ে তুপুরবেল! টেলিফোন করতেন, “আজকে কী খাবে। সোনা-” সোনাদি একদিক থেকে বলতো, “কেন রোজ য। খাও, টোম্যাটোর সুপ আর ছৃ'শ্লাইস ব্রেড -_, কন্ঠাপক্ষ ৬২ “না, আজকে চিকেন-রোস্ট করেছিল এখানে, খাবো একটু-+ “না, ডাক্তারকে প্রেসারট। দেখিয়ে, তারপর খেয়ো৷ যত পারো ।, জববলপুর থেকে স্বামীনাথবাবু লিখতেন, “তুমি কিছু ভেবো না, পুঁটুর জ্বর ছেড়েছে। কালকে নিরানববই ছিল, আজ আটানববুইতে নেমেছে। ডাক্তার ভাছুড়ি বলছেন,_-টাইফয়েড রোগ সেরে ওঠার পর কোথাও চেপ্ডে নিয়ে যাওয়া ভালো । ভাবছি অফিসে ছুটি নিয়ে কিছুদিন কোথাও ওকে নিয়ে যাবো একেবারে রোগা হয়ে গেছে, তুমি দেখলে আর চিনতে পারবে না খাবার টেবিলে সোনাদি একঘণ্টা ধরে বসে বসে খেতো'। তখন সবাই বাড়ির বাইরে | দাঁশসাহেব মাঝে মাঝে অফিস থেকে টেলিফোন করতেন। আর আমি তখন আমার গনল্প-লেখার খাতা নিয়ে পড়িয়ে শোনাচ্ছি। একট গল্প শেষ হলে আর একটা । এ একদিন নয়। সোনাদির সঙ্গে আলাপ হওয়ার প্রথম দিন থেকে কেমন যেন ভালো লাগতো । যখন কলকাতায় কেউ আমাকে চিনতো। না, তখন একমাত্র সোনাদির কাছ থেকে কী সাহায্যই না পেয়েছি । তবু সত্যিই কি সোনাদিকে চিনতে পেরেছি। কিম্বা চিনতে চেষ্টা করেছি। শুধু জানতাম, সোনাদি দ্রাশ- সাহেবের বিয়ে-করা স্ত্রী নয়। সে-কথ। ছুজনকে দেখে কিন্ত বোঝা যেত না। তিনটি মেয়েকে দেখেও বোঝ1 যেত না। সোনাদির আচার ব্যবহারে সমাঁজে-সভায় মেলামেশীতেও কেউ ধরতে পারতো না। বাড়ির চাকর- ঠাকুরের ব্যবহারেও সেজন্টে কিছু তারতম্য ছিল না। তেমনি সহজ স্বাভাবিক সুস্থ সম্পর্ক, যেমন আমার নিজের বাড়িতে দেখেছি । মাথার সিখিতে সিছুর। পায়েও আলতা । সাহেবী খানা ছিল বটে, কিন্তু সোনাদির জন্যে কুলের অন্বল কিম্বা ড'ট1-চচ্চড়ি রান্না হত মাঝে মাঝে। আর ওদিকে স্বামীনাথবাবু মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন সোনাদিকে । আমার কাছে সোনাদ্দির কিছুই গোপন ছিল না। সে-সব চিঠি বাইরেই পড়ে থাকতো।। কোনোটাতে লিখতেন, “একজন লাইফ-ইনসিওরের এজেন্ট এসেছিন--মার কি লাইফ-ইনসিওর করবো? ৬৩ কন্ঠাপক্ষ সোনাদি লিখতো, 'লাইফ-ইনসিওর না করে বরং বাঁড়িট। সারাও, কিন্বা কলকাতায় একট। বাড়ি করো । চাকরি থেকে রিটায়ার করে তখন কী করবে তিনি লিখতেন, “তোমার কথামতো দুধ খাওয়। সুরু করেছি এবার ।, সোনাদি লিখতো, “আসছে মাস থেকে দুধ খাওয়া আরো বাড়াবে-_ আধসের নিজের জন্যে রাখবে ।” এমনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর । যখন সোনাদির সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল তখন এ-সব কৌতুহল ছিল নাঁ। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীকেও যে এক-বাড়িতে এক ঘরে বাস করতে হয়, এ-সন্বন্ধে কোন সঠিক ধারণা ছিল না। একবারও মনে হয়নি সোনাদির স্বামী কেন জববলপুরে থাকেন। তিনিও কেন একবার আসেন না৷ এখানে । কিন্বা সোনাদিই বা একবার জববলপুরে যায় না কেন? ন্বামীনাথবাবুই যদ সোনাদির স্বামী তো দাশসাহেব কে? দাশসাহেব এ-বাড়ির কে? সোনাদির সঙ্গে দাশসাহেবের সম্পর্কটা কিসের? বেশিদিন যাতায়াত করতে করতে, বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে এ-সব সম্বন্ধে যখন কৌতৃহল হবার কথা৷ তখন সোনার ব্যবহারে এত মুগ্ধ হয়ে গেছি যে, ও সব কথ! আর ভাববার অবসর পাইনি । সোনাদি যে কাকে বেশি ভালোবাসতো ধরা শক্ত । একবার মনে হত তার নিজের স্বামীকে, আর একবার মনে হত দাশসাহেবকে । আবার কখনও মনে হত--আমাকে ! সেই স্বামীনাথবাবুর সেবার হঠাৎ অসুখের খবর এল। এখন যায়, তখন যায়। সোনাদির কাছে গিয়ে বসে থাকি । ওদিক থেকে টেলিগ্রাম আসে আর এদিক থেকে টেলিগ্রাম যায়। আমি চুপচাপ শুধু বসে থাকার বেশি আর কী করতে পারি ! | স্বামীনাথবাবু চাকরি করতেন জববলপুরে । জববলপুরের পোস্টাপিসের ছাঁপমারা চিঠি এলেই আমি জব্বলপুরের কথা ভাবতে বসে যেতুম। ভাববলপুরেও কতদিন ছোটবেলায় কাটিয়েছি। জব্বলপুরের কালোজাম- দিদির কথা, মিছরি বৌদির কথা মনে পড়তে। আমার । মনে পড়তো কন্াপক্ষ ৬৪ নেপিয়ার টাউনে কালোজামদিদির বাড়িতে আমাদের সেই ফুটবল খেলার কথা! সেই “মনোহর-দি-মাকালফলে'র কথা! সব মনে পড়ে যেন। সেই মনোহরের সঙ্গে সেদিন এতদিন পরে হঠাৎ দেখাও হয়ে গিয়েছিল। সোনাদির কথা পরে বলবো । তার আগে জব্বলপুরের গল্পটা বলে নিই। জববলপুরের মনোহর । মনোহর মানেই আমাদের নেপিয়ার টাউনের কালোজামদিদ্ি। প্রথম প্রথম কলকাতায় এসে সোনাদিকে দেখে আমার কেবল কালোজামদিদ্িকেই মনে পড়তো । মনে হত কালোজামদিদ্ি আর সোনাদির সঙ্গে যেন কোনও তফাত নেই । যেন দুইজনেই একরকম । কিন্তু আরো ভালো! করে চেনবার পর বুঝলাম, আমারই ভূল । সোনাদিকে বাইরে থেকে যা মনে হত, আসলে তা নয়। আর কালোজামদিদে ? ছোটবেলাটা আমার জববলপুরেই কেটেছে । কলকাতায় এসে যেমন আমার সোনাদি হয়েছে, জববলপুরে তেমনি ছিল আমার কালোজামদিদি। সেদিন হঠাৎ রাস্তায় মনোহরের সঙ্গে দেখা হওয়ায় কালোজামদিদিকে আবার বেশি করে মনে পড়লে । আমার চরিত্রের একট। মুদ্রাদোব আছে । হ্যা, মুদ্রাদোব ছাড়া আর কী বলবো ! রাত্রে ঘুম আসবার আগে সারাদিনের ঘটনাগুলো একবার ভেবে নিই। কোন্‌ লোকের সঙ্গে দেখ! হল, কার সঙ্গে কী কী কথা হল, কোন্‌ নতুন বই পড়লাম, নতুন কী শিখলাম--সমস্ত দিনের লাভ- লোকসানের হিসেবটা এই বিছনায় শুয়ে শুয়ে একবার খতিয়ে নি রোজ । কিন্তু প্রতিদিন এই ধারণা নিয়েই ঘুমৌই যে মনে রাখবার মতো! কিছুই ঘটেনি, কিছুই করিনি বা শেখবাঁর মতে। কিছুই পাইনি । প্রতিদিন একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হয়। তবু চরিত্রের এই মুদ্রাদোৰ আজও ছাড়তে পারিনি আমি ! সেদিন কিন্তু এর ব্যতিক্রম হল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়লো, আজ তো! সকালবেল। মনোহরের সঙ্গে দেখা হয়েছে। মনোহর-দি-মাকাঁলফল ! স্কুলে কী আকাট ছিল মনোহর । এখনও কিন্ত ৬৫ কন্তাপক্ষ মনোহর চেহারাটা সেইরকমই রেখেছে । নিখুত নিভীজ স্যুট, সগ্ঠ দাড়ি- কামানো মুখের সেই গ্রীসিয়ান কাট্‌, একটা পাকও ধরেনি চুলে, দামী সিগ্রেট মুখে ! গরীবের ছেলে মনোহর-_কিস্তু ছোটবেলা থেকেই ওকে দেখে তা বোঝবাঁর উপায় ছিল না। চৌরঙ্গীর একটা হোটেল থেকে বেরুচ্ছিল। প্রথমটায় না চিনতে পারারই কথা । অনেক দিন দেখিনি । আমাকে দেখে থেমে গেল, আরে ! চিনতে পারিস-_? ভালো করে চেয়ে দেখলাম । মনোহর-দি-মাকালফল ! কিন্তু হয়ত এখন একটা-কিছু করছে নিশ্চয়ই ! এতবড় হোটেলে থাকবার মতো সামর্থ্য তা না হলে হল কী করে! যুদ্ধে অমন কত রত্বই তো! তরে গেছে__ মনোহরও হয়ত তেমনি একটা কিছু বাগিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে! বলা যায় না! আমার হাঁত ছুটে ধরে একটা ভীষণ ঝাকুনি দিলে মনোহর । বললে, 'ছাড়বে। না তোকে আজ-_তুই তো! রীতিমতো ফেমাস্‌ হয়ে উঠেছিস রে !, বললাম, “কী করছিস আজকাল ? মনোহর ছুটে! হাতের পাতা চিত করে কাধ ছুটো। নাচিয়ে বললে, “কিচ্ছু না ।? তারপর একট? চল্তি ট্যাক্সিকে থামিয়ে বললে, “আয়-_ চলে আয়।” অবাক্‌ হয়ে গেলাম । বললাম, “কোথায় ? মনোহর বললে, আয় না, কোনও কাজ নেই তো। তোর--গল্প করবে আরো অবাক হয়ে গেলাম । মনে আছে, আমাদের সকলের দাতব্যের ওপর নির্ভর করেই মনোহরের চলতো । ইন্কুলের জলখাবারটার জন্যে আমাদের ওপরেই নির্ভর করতে হয়েছে ওকে । জামা কিনে দিত ওর কোন্‌ মামা, জুতো কিনে দিত ওর কোন্‌ পিসেমশাই, স্কুলের মাইনেও দিত কোন্‌ জামাইবাবু কিন্তু দাতব্যের ওপর নিভর করে এই বাবুয়ানি করা একমাত্র বোধহয় ওই মনোহরকেই দেখেছি । কিন্ব। হয়ত ওর চেহারার গুণে সাদাসিধে পোশাকও জমকালো হয়ে উঠতো ওর গায়ে । কগ্ঠাপক্ষ ৬৬ পকেট থেকে পার্স বা"র করে মনোহর ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিলে । তারপর একট রেস্ট,রেন্টে ঢুকে পড়লো আমাকে নিয়ে। লম্বা লম্বা দামী অর্ডারও দিয়ে বসলো । খেতে খেতে আবার বললাম, “কী করছিস আজকাল ? একটা সিগ্রেট ধরিয়ে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে মনোহর বললে, “কিচ্ছু না! তারপর আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বললে, “দেখে অবাক্‌ হচ্ছিস বুঝি, এসব কোথেকে আসছে ? তোরা তো! বলতিস, মনোহর-দি-মীকাল- ফল! এখন মাকালফলের কদর বেড়েছে রে' । তবু কৌতুহল মিটলো না । বললাম, “এসব কাঁর টাকা? কোঁথেকে পেলি? কে দিচ্ছে? মনোহর বললে, “কাঁলোজাম দিদি 1” কালোজামদিদি ! কালোজামদিদি বেঁচে আছে এখনও ! সে কত দিনকার কথা । মনোহর বললে, পীড়া, পেটে খানিকটা ঢালি আগে, চুমুক দিতে দিতে বলব সব তোকে--সেই গল্প বলতেই তো! তোকে ডেকে এনেছি এখানে । তুই খাস তো, না সেইরকম সাধু হয়ে আছিস এখনও ? সেদিন রাত্রে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কালোজামদিদির চেহারাট। ভাবতে চেষ্টা করলাম । সেই কালোজামদিদি ! এখন বয়স নিশ্চয়ই ষাটের কাছাকাছি । ছোটবেলায় বার বার আমার মনে হত-_কালোজামদিদির নামট1 কে রেখেছে ! কিন্ত যে-ই রাখুক, তার রসঙ্গান আছে বলতে হবে। কালোজামদিদিকে দেখতাম বারান্দার ওপর একটা দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে ছলছে। ফরসা ধবধব করছে মুখটা। সামনের বাগানের ওপর আমরা খেলতে খেলতে দেখেছি কালোজামদিদি দোলনায় ছুলতে-ছুলতে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। ফুটবলট। যদ্দি কখনও গড়াতে গড়াতে গিয়ে কালোজামদিদির কাছাকাছি গিয়ে পড়তো, আমি ছুটে যেতাম বলটা কুড়োতে। তার কাছে গেলেই কেমন একটা সুন্দর গন্ধ আসতো নাকে। আজ পর্ধন্ত অন্য কারো শরীরে সে-গন্ধ পাইনি । সিক্কের শাডির খসখস টি কন্তাপক্ষ শবের সঙ্গে সেই সুন্দর স্ুম্পষ্ট গন্ধ আর কোথাও পাইনি কখনও | বলটা যদি তার পায়ে গিয়ে ঠেকতো৷ কোনদিন তো সমস্ত শরীরে কেমন রোমাঞ্চ হ'ত। ময়লা ধুলোমাখা ফুটবলটাকে বুকে করে বাড়ি ফিরতাম সেদিন। এক এক দিন কালোজামদিদির মেজাজ কীজানি কেন খুব ভালো হত। আমাদের ডেকে বলতো, “যে দৌডে ফাস্ট” হতে পারবে, তাকে এই কমলালেবুটা দেব ।' আমরা পনরো-যোল জন ছেলে লাইন বেঁধে দাড়াতাম। কালোজাম- দিদ্রি সঙ্কেত করলেই সবাই একসঙ্গে দৌড়,বৌ। আমার স্বাস্থ্য বরাবরই খারাপ। দৌড়-ঝপের মধ্যে আমি বিশেষ যেতে পারি না। আমি জানতাম আমি হেরে যাবো । কিন্তু কেন জানি না, ওই কমলালেবুটার লোভে কিনা, কিংবা কালোজামদিদির হাতের ছোঁয়া পাবে। বলে কিন। সমস্ত শরীরে একটা উত্তেজনা অন্ুভব করতাম । সত্যি সত্যিই যখন সকলকে হারিয়ে ফার্ট হতাম-সে যে কী অনুভূতি! আমার ফার্টঁ হওয়াটা! কেউ আশা করেনি । কালোজাম- দিদিও না। তাই মুখটা তত প্রসন্ন নয় তার। তবু মনে আছে, প্রথমবার কালোজামদিদ্ির হাত থেকে কমলালেবুট। নিতে গিয়ে যেন সামলাতে পারিনি । সই ইজি-চেয়ারে-বসা কালোজামদিদ্রির গায়ের ওপরেই পড়ে গিয়েছিলাম | কালোজামদিদি হঠাৎ আমাকে ধরে ফেলেছিল। বললে, এক রে, এত হাপ।চ্ছিস কেন ?? আমার তখন বয়েস দশ এগারে। বছর আর কালোজামদিদির হয়ত পয়ত্রিশ। আমি মুখটা তখনও কালোজামদিদির শাড়ির মধো গু'জে পড়ে আছি। অতগুলো৷ ছেলের সামনে কাঁলোঁজামদিদি আমাকে ছুই হাতে ছাড়িয়ে নিয়ে জোরে গাল টিপে দিয়েছিল; বলেছিল, “কী হাব! ছেলে রে, দিলি তো। আমার শাড়ি ময়ল। করে ? সেইদিন থেকে সুবিধে পেলেই কালোজামদিদ্রির কাছে-কাছে ঘোরা- ফেরা করতাম। তারপর একদিন আবার কালোজামদিদি চলে যেত কন্ঠাপক্ষ টি শ্বশুরবাড়ি । এলাহাবাদে না কোথায় ছিল শ্বশুরবাড়ি। কালোজামদিদির স্বামীকে কখনও দেখিনি । কিন্তু লীলাঁকে দেখতাম । কালোজামদিদ্ির একমাত্র মেয়ে লীলা । ঠিক যেন কালোজামদিদির ছোট সংস্করণ । আমাদের বয়সী। যখন কালোজামদিদি চলে যেত, কিছুতেই ভালো লাগতো না। বাড়ির চাকর-বাকরদের জিগ্যেস করতাঁম, “কালোজামদিদি কবে আসবে রে? জ্যাঠামশাই নিচে নামতেন না। তার কাছে যেতে ভয় করতাম । বিরাট মার্বেল পাথরের বাড়ি। কালোজামদিদি চলে যাবার পর অতবড় বাড়িটা যেন একেবারে জনশূন্য হয়ে যেত। আমর! পাড়ার ছেলেরা জ্যাঠামশাই-এর বাগানে গিয়ে খেলতাম । ওইটেই ছিল খেলার জায়গ1। ও-বাঁড়ির সঙ্গে পাড়ার ছেলেদের যে কিসের সম্পর্ক তা বোঝা যেত ন1। তবু জব্বলপুরের নেপিয়ার টাউনের সেই মার্বেল পাথরের বাড়িটার সামনে বাগানটাই ছিল আমাদের সমবয়সী ছেলেদের একমাত্র খেলার জায়গা । একদিন মনোহর বললে, “এই, কাল কালোজামদিদি আসছে ।, বললাম, “ক করে জানলি ? কিন্ত আর কিছু ভাঙলো না মনোহর । সে-রাতট! যে কী করে কাটলে ! কালোজামদিদি আস' মানে আবার সেই রোমাঞ্চ । বাগানের গাছগুলো আবার ছটা হল। ঘর-দোর সাফ করা চলতে লাগলো! । জ্যাঠামশাই-এর গলা শোনা গেল দু-এক বার। আর পাখি? পাখিও দেখি যেন সেজে-গুজে বেড়াতে বেরুচ্ছে চাঁকরের সঙ্গে । কালোজামদিদির নিজেরই ভাই পাখি । আমাদেরই বয়সী । হাবা-গোবাঁ, কথ! বলতে পারে না, হাসলে মনে হয় যেন ভেঙচি কাটছে। জ্যাঠামশাই-এর একমাত্র মেয়ে কালোজামদিদি আর একমাত্র ছেলে পাখি । চাঁকরের সঙ্গে দিনরাত থাকে পাখি। এ বিকলাঙ্গ ছেলেটার জন্মের পরেই নাকি কালোজামদিদির মা মারা যায়। বন্বেমেল আসবার সময় একলা চুপি চুপি গিয়ে ঈাড়িয়ে আছি ৬৯ কন্তাপক্ষ স্টেশনের কাছে। কালোজামদিদি এই ট্রেনেই আসবে। কেমন যেন থরথর করে কাপছিলাম। কালোজামদিদি একলা ট্রেনের ফাস্ট ক্লাস কামরা থেকে নামলো । আমাকে দেখে বললে, “কী রে, চিনতে পারিস? তারপর পাশে চেয়ে বললে, “আরে, মনোহর এসেছে যে--আর ফটিক, তুইও ?+ চারদিকে চেয়ে দেখি, আমাদের দলের সবাই এসেছে । কেউ কাউকে বলিনি ৷ কালোজামদিদ্ি আবার বললে, 'বল খেল আছে বুঝি এদিকে ? আমি বললাম, "হ্যা, ফটিক বললে, “না কালোজামদিদি, তোমাকে দেখতে এসেছি ।, তাই নাকি” বলে ফটিকের গালট। জোরে টিপে দিয়ে একগাল হেসে উঠলো! কালোজামদিদি। পাখিকে নিয়ে জ্যাঠামশাই-এর গাড়ি এসেছিল স্টেশনে । কালোজাম- দিদি তাইতে চড়ে চলে গেল। কিন্তু আমি যেন তখনও কালোজামদিদির গায়ের সেই অদ্ভুত গন্ধ বুক ভরে টানছি। এক এক বার কালোজামদিদির সঙ্গে লীলাও আসতো । তারপর আমাদের বল খেলা চলতো দ্বিগুণ উৎসাহে । লীল। বুঝি দাজিলিং ন। কাশিয়া-এ কোন্‌ মিশনারী স্কুলে পড়তো । ছুটিতে আসতে। এলাহাবাদে মায়ের কাছে । যে কদিন কালোজামদিদি থাকতো নেপিয়ার টাউনের বাড়িতে, ক'দিন আবার পেতাম সেই গন্ধ। সার! বাড়িটাতে সেই গন্ধ ভুরভূর করতো । নান। ছুতো করে সকালবেলাও গেছি কালোজামদিদির কাছে । সকাল- বেলাট। বড় ব্যস্ত থাকতো কালোজামদিদি। জ্যঠামশাইএর চাকর দুখ মৌচন একট শিলের ওপর অনেকগুলে। কমলালেবু বাটছে। খোলা- সুদ্ধু, সেই কমলালেবুর রস গরম জলে সেদ্ধ হবে, আর তাই দিয়ে কালোজামদিদি স্লান করবে! অলিভ-অয়েল থাকতো বোতল ভর! । কন্তাপক্ষ ৭৬ সেই অলিভ-অয়েল মাখ। চলতো! সকালবেলা দু'ঘণ্টা ধরে, তারপর সেই কমলালেবুর রস মাখানো গরম জলে আ্ান। বাথরুমে যে কত রকমের সাবান! স্নান করতে যাবার মুখে তোয়ালে নিয়ে কালোজদিদির আয়া দাড়িয়ে থাকতে। বাথরুমের দরজায় । তারপর সেই স্নান চলতো বেল! দশটা পর্ন্ত। যখন বেরুত কালোজামদিদি, সে এক অন্য মানুষ ! বাড়ির মধ্যে আমাকে দেখে কালোজামদিদি জোরে গাল টিপে দিত, ই করে কী দেখছিস রে হাবা ছেলে-_লেখাপড়। নেই? স্কুলে যাবি না? “বা রে, আজ যে রোববার । তখনকার সেই অন্পবয়েসে মনে আছে-আমাদের সকলের কাছে কালোজামদিদি ছিল একট! স্বপ্ন, একটা বিস্ময় ! লেখাপড়া, ঘুম, খেল! সমস্তর মধ্যে কালোজামদিদি কেমন আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল । কালোজামদিদিকে ঘিরেই আমাদের কল্পনা, তাকে নিয়েই আমাদের স্বপ্প। বাড়িতে পড়তে বসেও হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম । মনে হত, কালোজামদিদির সেই ফরসা, টোপা৷ কুলের মতে! ফোলা -ফোল৷ হাতের আন্গুল দেখছি যেন। কালোজামদিদির সেই ঢটেউ-খেলানো চুলের রাশ, সেই সিল্কের শাড়ির খসখস শব্দ, সেই অদ্ভুত গায়ের গন্ধ__সার! দিন, সারা রাত আমাঁদের মনকে মুখর করে রাখতো | | কালোজামদিদির আহলে বোধহয় খুব জোর ছিল, নইলে আমাদের গাল টিপলে অত লাগতো কেন? তবু কালোজামদিদি যেদিন গম্ভীর হয়ে থাকতো, সেদিন চেয়েও দেখতো। না আমাদের বল খেলা । যেদিন গাল টিপতে ভূলে যেত, সেদিন ভারি খারাপ লাগতে! আমাদের । কিছুতেই কিছু ভালে। লাঁগতে। না আর যেন। কিন্ত একদিন খেলতে গিয়ে কেমন যেন অবাক লাগলো । পাখি চাকরের সঙ্গে আর বেড়াতে বেরোল ন? সেদ্রিন। বাঁড়ির দরজা-জানল- গুলোও খোল হয়নি । ' সমস্ত বাড়িটা যেন খাঁ-খা! করছে। চাকর- বাকরদের গলাও যেন শোনা যাচ্ছে না। মনোহর বললে, শুনেছিস, কালোজামদিদির বর মরে গেছে ॥ ৭১ কন্তাপক্ষ সেকি! মনোহর বললে, হ্যা, শুনেছি আমি । টেলিগ্রাম এসেছে, হঠাঁং হার্টফেল করে মরে গেছে । কালকে এখানে চলে আসছে কালোজা মাঁদদি ।, সেদিন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে কী কান্নাটাই না কীদলাম । কেন কাদলাম জানি না। মনে হল, পিসীম। যেমন পিসেমশীই মারা যাবার পর সাদ। কাপড় পরেছিল, মাছ-মাঁংস খায় না, কালোজামদিদিও যদি সেই- রকম করে! পিসীমাঁকে বিধবা হওয়ার পর যেমন কাদতে দেখেছিলাম, কালোজামদিদিকেও ষেন কল্পনায় সেইরকম কাদতে দেখলাম | আমি আর মনোহর সেদিন আবার স্টেশনে গিয়ে দাড়ালাম । চোখ ছলছল করছিল আমার । বিধবার পোৌশাক-পর! কালোজামদিদিকে প্রথম দেখে কী করে যে কথা বলবো তাই ভাবছিলাম | বন্ধে-মেল এল। বুক ছুরছুর করে কাপছিল। কী দৃশ্য দেখবো কে জানে ! দেখলাম, কালোজামদিদি নামছে । চোঁখছুটে। বুঁজে ফেললাম আমি । আমি যেন আর সহ্য করতে পারছিলাম না । কিন্তু কালোজামদিদি আমায় দেখতে পেয়েছে ঠিক। সামনে এসে আমার আর মনোহরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো । বললে, “আমাকে দেখছি ভূলিসনি তোরা ? ওঠ, গাড়িতে ওঠ |” বলে কালোজাম- দিদি আমাদের পাশে বসিয়ে নিলে। মুখ উচু করে দেখতে সাহস হচ্ছিল না! তব্‌ কালোজামদিদির শিক্ষের শাড়ির খসখস শব্ষ আর সেই অদ্ভুত গন্ধের মধ্যে বিভোর হয়েছিলাম। কালোজামদিদির একেবারে গা! ঘেষে বসেছি। আমাদের দুজনকে ছু'হাত দিয়ে ধরে আছে। গাড়িটা! পিচের রাস্তার ওপর দিয়ে শ-শ” করে চলেছে । মাঝে মাঝে ঝাকুনি দেয়, আর আমরা তিনজনেই একসঙ্গে ছুলে উঠি। কালোজামদিদির হাতের সোনার চুড়িগুলে। আমার বুকের ওপর ফুটছে, লাগছেও খুব, তবু নড়তে সাহস হল না। যদি কালোজামদিদি হাত ছাড়িয়ে নেয়। মনে হল, এমনি করে যদি মাইলের পর মাইল ছুলতে ছুলতে যাওয়া যেত, বেশ লাগতো । আমি এক কন্ঠাপক্ষ ৭২ সময়ে সেইভাবে থাকতে-থাকতে হঠাৎ কালোজামদিদির কোলের ওপর সিক্ষের শাড়িটার মধ্যে মুখ গু'জে হাউ-হাউ করে কাদতে লাগলাম । কালোজামদিদি আরো জোরে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলে আমায় । বললে, “এ কী হাব! ছেলে দেখো-ছি, কাদতে নেই অমন করে !, দিদির সান্ত্বনাতে আমার কান্না আরো বেড়ে গেল। সেদিন মনে আছে বাড়ি আসার পথে খুব কাদছিলাম দেখে মনোহর বলেছিল, “কাদছিস কেন রে, ভালোই তো! হল !, বললাম, “কেন? মনোহর বললে, “এবার থেকে আর কালোজামদিদি কোথাও যাবে না, এইখানেই থাকবে ! মনোহরের কথায় আমারও যেন কেমন আনন্দ হল। স্বার্পরের মতো ভাবলাম ঃ বেশ হল, ভালোই তো। হল! বরাবর কালোজামদিদি এই নেপিয়ার টাউনের বাড়িতেই থাকবে, রোজ দেখতে পাবো তাকে, রোজ আমাদের গাল টিপে দেবে কালোজামদিদি । সত্যি য। ভেবেছিলাম তাই হল। কালোজামদিদ্ি বিধবা হবার পর যেন আরো! ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো আমাদের । কালোজামদিদিকে আরো স্বন্দর দেখাতে লাগলো । আরে! মিষ্টি। আরো নিজেদের জিনিস ! ও-বাড়িতে যাওয়া আরো! বেড়ে গেল আমাদের । সকালবেলা আরে বেশি করে কমলালেবু আসে । ছুখমোচন আরো কমলালেবু বাটে, দুধের সর দিয়ে কমলালেবু বেটে গায়ে মাখে কালোজামদিদি। তারপর ছুধ দিয়ে ধুয়ে ফেলে সবটা1। আর তারপর গরম জলে স্নান। বাথরুমের বাইরে দ্াড়ালে কেমন ভূরভূর করে গন্ধ আসে নাকে । তারপর স্নান সারা হবার পর ভিজে চুল এলিয়ে দিয়ে সিক্কের রঙিন শাড়ি পরে দোলনায় বসে দোলা খায়। আমাদের দল ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে । আগে পনরো-ষোল জন ছিলাম, এখন আমাদের ক্লাসের অন্ত ছেলেরাও আসতে আরম্ভ করল। মধু, মান্‌কে, দীপর্টাদ--ওরাও আসতে সুরু করেছে। ছুটির দিন দল আরও ৭৩ | কন্াপক্ষ ভারী হয়। গোলবাজার থেকে সাইকেলে করে আসে হাবুল। এতোয়ারী বাজার থেকে আসে পঞ্চা। কাঁলোজামদিদি সকলেরই গাল টিপে দেয়! সকলকেই সমান আদর করে। কার ওপর যে বেশি পক্ষপাতিত্ব বোঝ। যায় না। দিন-রাত চেষ্টা করি কেমন করে বেশি প্রিয়পাত্র হতে পারি কালোজামদিদির। ভোরবেলা! কালোজামদিদির ঘুম ভাঙবার আগেই ও-বাড়িতে গিয়ে তার শোবার ঘরের দরজার সামনে বসে থাকি । ঘুম থেকে উঠলেই দেখতে পাবে আমাকে । একলা আমাকে । এত সকালে আর' কেউ আসতে পারে না । কতদিন ম। বকেছে, দাদার! মেরেছে-_কিছুতেই কেউ বশে আনতে পারেনি আমাকে । আমাদের দলের সব ছেলেরা একই আকর্ষণে আসে এখানে । এত ছেলে যে, বাগানে ধরে না। নেপিয়ার টাউনের মার্বেলের বাড়িটা মামাদেরই মতো বাচ্চা ছেলেদের ভিড়ে দিন-রাত উচ্চকিত থাকে । কালোজামদিদির সছ্য ঘুম-ভাঙা চোখ । কৌকড়ান চুলের রাশ। ভারি ভালো লাগল দেখতে । হাঁসতে হাঁসতে কালোজামদিদি বললে, “কী রে, এত সকালে যে? রাত্রে বুঝি স্বপ্নে দেখেছিলি দিদিকে ? লজ্জায় আমার মুখ রাঙা হয়ে উঠলে? । বললাম, “তুমি ছুলবে না ?, কালোজামদিদি হেসে আমার গাল টিপে দিলে । বললে, “তুই দোলাবি বুঝি? বললাম হ্যা ।; কালোজামদিদি বললে, 'আচ্ছা, এখন দোল? তুই, কিন্তু হুপুরবেলা আজ হাবুল দোলাবে। ওকে আমি কথ দিয়েছি, ও অনেক দূর থেকে আসে ।, “আর বিকেলবেলা আমি দোলাবো তোমায় ? 'বিকেলবেলা আজ পঞ্চ দোলাবে, ও সেই এতোয়ারী বাজার থেকে আসে।' শেষকালে কালোজামদিদিকে নিয়ে আমাদের মধ্যে রীতিমতো প্রাতি- যোগিতা হতে আরম্ভ হল। ঝগড়া সুরু হল, কে কালোজামদিদিকে দোলাবে তাই নিয়ে। ফুটবল খেলা আমাদের উঠে গেল । কন্ঠাপক্ষ ৭৬ কালোজামদিদি বললে, “মনোহরট তে? ভারি ফাকিবাজ--মনোহর-দি- মাকালফল | তারপর-থেকেই কালোজামদিদ্ির দেওয়া নামটা ধরেই আমরা ডাকতাম মনোহরকে বরাবর | পরের দিন স্কুলে গিয়ে বললাম, “কাল যাসনি কেন রে কালোজামদিদির বাড়িতে ? মনোহরের বেশ মন খারাপ দেখলাম । বললে, “ভাই, একট। পয়সাও যোগাড় করতে পারলাম না কোথাও । মামার কাছে গিয়েছিলাম, পিসেমশা ই-এর বাড়ি গিয়েছিলাম, জামাইবাবুর কাছেও গেলাম_ জানিস সকলেরই মাসের শেষ দিক । শুধু-হাতে যেতে কেমন লাগলো আমার ।” বললাম, কালোজামদিদি কালকে তোকে মনোহর-দি-মাকালফল বলেছে । মনোহর বললে, “শুনেছি আমি । কিন্ত কালোজামদিদিরই তো। দোষ, বেছে বেছে মাসের শেষের দিকে ওর জন্মদিন পড়ে কেন ? এমনি করে বেশ দিন কাটছিল। কিন্তু বাধা পড়লো! একদিন । লীল! লেখাপড়া শেষ করে নেপিয়ার টাউনের বাড়িতে এসে উঠলে । আর কোথা থেকে এক দেব-ছুবিপাকে কী হয়ে গেল সব, আজও ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। রোজকার নিয়মমতে। সেদিনও আমর গেছি কালোজামদিদির বাড়ি । বাইরে দেখলাম, বিরাট একটা। মোটর । নতুন ঝকঝকে মোটর । ড্রাইভার নেই । সামনেই ছুখ মোচনের সঙ্গে দেখা হল। বললাম, “কে এসেছে রে? ছুখমোচন বললে, বাজোরিয়া সাহেব ।, কে বাজোরিয়া সাহেব! কেন এসেছে! এই সব প্রশ্ন করছিলাম নিজেদের মধ্যে। আমাদের কালোজামদিদিকে কেড়ে নেবে নাকি! নিয়মমতে। বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি কালোজামদিদি লীলাকে সঙ্গে করে আসছে । সঙ্গে একজন স্ুযুট-পরা লোক ! লম্বা-চওড়া, রি কন্ঠাপক্ষ হোমরা-চোমরা চেহারা । ছোকরা! মানুষ ৷ বেশি বয়েস নয়! কালোজামদিদি এক হাতে লীলার একটা হাঁত ধরেছে, আর একটা হাত সেই লোকটার কাধের ওপর | তিনজন মিলে মটরে উঠতে যাচ্ছিল । আমাদের দেখে কালোজামদিদি এগিয়ে এল । বললে, “তারা এসে গেছিস, বোস একটু, আমি মিস্টার বাজোরিয়ার সঙ্গে একটু ঘুরে আঁসি। চলে যাঁসনে যেন, আধ-ঘণ্টার মধ্যেই আসবো ।, তারপর তিনজনে গিয়ে উঠলে। মোটরে। মোটরট1 একবার একটু মৃছু আর্তনাদ করে ছেড়ে দিলে । আমর কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেলাম |! কোথাকার কে এসে আবার ভাগ বসালে আমাদের কালোজামদিদির ওপর। কেও! কীচায়? মন খারাপ হয়ে গেল সকলের । সবাই রয়েছি, কিন্ত কাঁলোজামদিদির অবর্ত- মানে যেন সব অর্থহীন হয়ে গেল ! আধঘণ্টা কেটে গেল। একঘণ্টাও কেটে গেল । রাত আটট। বাজতে চললো, তবু কাঁলোজামদিদির দেখ। নেই । গোলবাজারের হাবুল সাইকেলে চড়ে চলে গেল। এতোয়ারী বাজারের পঞ্চাও আর থাকতে পারলো না । একে একে সবাই চলে গেল। সবারই মনের ভাব £ কাল কালোজাম- দিদির সঙ্গে একট বোঝাপড়া করে ফেলতে হবে । কালোজামদিদি সত্যিই আমাদের চায়, না, ওই বাজোরিয়া সাহেবকে চায় । স্পষ্ট জবাব চাই ! আমি বাড়ি যাঁবার পথে পা! দিয়েও বাড়ি ঢুকতে পারলাম না। অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে প্রায় ছু"ঘণ্টা পরে আবার কালোজাম- দিদির বাড়ির সামনে এসে হাজির । মোটরট নেই আর তখন। তাহলে কি তারা এখনও ফেরেনি ? কালোজামদিদি খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছে । তখনও ঘুমোতে ায়নি | বললে, “কি রে এত রাত্তিরে ? কালোজামদিদিকে দেখে আমি আর সামলাতে পারলাম না! দিদির শাড়ির জাচলট। নিয়ে মুখ ঢেকে হাউ-হাউ করে কাদতে লাগলাম । কন্যাপক্ষ ৮” দিদি বললে, “কী হাব! ছেলে রে, আমার দেরি হয়েছে বলে বুঝি ছুঃখু হয়েছে? ওরা সব কোথায় ? দিদি আবার বললে, “তোরাই তো আমার প্রাণের বন্ধু রে, ও লোকটা তো নতুন এসেছে--লীলার সঙ্গে বিয়ে হবে কিনা ওর-_-তাই ওর সঙ্গে একটু ভাব করছিলাম ।, আশ্চর্য আমার মন। কালোজামদিদির ওইটুকু কথাতেই মন একেবারে ভিজে গেল। এত যে অভিমান অভিযোগ, সব মুছে গেল ! এক মুহূ্ে ক্ষমা করে ফেললাম কালোজামদিদিকে! নিজের শাড়ির আচল দিয়ে আমার চোখ-মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললে, যা, অনেক রাত হল, এবার বাড়ি য! লক্ষ্মীটি-কাল সকাল-সকাল আসিস ।' কিছুদিনের মতো এ ব্যাপারটা মিটে গেল বটে, কিন্তু সাত দিন পরেই আবার ওই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। আবার বাজোরিয়া সাহেব এল। আবার মোটরে করে বেরিয়ে গেল তিনজনে । বাজোরিয়৷ সাহেবের সঙ্গে লীলার বিয়ে হবে তো হোক না, কিন্তু কালোজামদিদি ওদের সঙ্গে যাবে কেন শেষে মাসের মধ্যে ছ'দিন সাতদিন আসতে লাগলো বাজোরিয়। সাহেব। নিজে মোটর চালিয়ে আসে। আবার কালোজামদ্রিদিকে আর লীলাকে বেড়িয়ে নিয়ে এসে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে, ধেশায়। উড়িয়ে চলে যায় । মনোহর বললে, “খবর পেয়েছি, ও লোকটা সাতনার ম্যাজিস্ট্রেট, নতুন আই. সি. এস_- ফটিক সেদিন স্প্টাম্পষ্টি বললে, “তোমাকে সত্যি করে বলতে হবে কালোজামদি, তুমি আমাদের, না, ও লোকটার ? কালোজামদিদি দোলনায় ছুলতে-ছুলতে ফটিফের গাল টিপে দিলে । বললে, “ছুরু বোকা ছেলে, ও-কথা বলতে আছে ? আমি হলুম তোদের দিদি আর ও-লোকটার শাশুড়ী। কিচ্ছু বুঝিস না, ও যে আমার জামাই হবে রে।? কিন্ত দিন দ্রিন বাজোরিয়া সাহেবের আসা বাড়তে লাগলো । কোথায় সেই সাতনা! সেই একশে! মাইল দূর থেকে লীলার জন্যে মোটর চালিয়ে আসে, আবার সেই রাত্রেই ফিরে যায়! রবিবার দিন সকালবেলাই চলে নর কন্তাপক্ষ আসে। সমস্ত দিনট] কাটায় এখানে । খাওয়া-দাওয়া করে। মার্বেল রকৃস্‌ দেখতে যায় ছুইজনকে নিয়ে। আস্তে আস্তে সত্যিই আমরা যেন পর হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারি। কালোজামদিদি কিন্ত মুখে বলে, এই গ্ভাখ না, সামনের বোশেখ মাসে লীলার বিয়েট। হয়ে যাক্‌, তখন আবার সারাদিন তোদের সঙ্গে কাটাবো_ আবার তোর আমাকে দোলাবি আগের মতন ।' আমরা কেবল দিন গুনি। কবে বোশেখ মাস আসবে । কবে বিয়েট। হয়ে যাবে ওদের। বাঁচা যায় তা হলে। তখন আবার কালোজাম দিদি আমাদের । কালোজামদিদি একদিন বললে, “আচ্ছা, এত যে তোরা আমাকে ভালবাসিস, তোদের যখন বিয়ে হবে আমাকে তুলে যাবি তে।?, আমরা সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠি, “কখখনো না, কালোজাম- দিদি--কখখনো না।? সত্যিই তো, কালোজামদিদিকে কি ভোলা যায়? তুমি আমাদের ভালবাসে। আর নাঁবাসো, তোমাকে ভাল না-বেসে কি থাকতে পারি? কালোজামদিদিকে ন। দেখে ষে বাচতে পারা যায়, এ কথা তখন কল্পন! করতেও ভয় হয়। এখন মনে পড়লে হাসি পায় অবশ্য ! কিন্তু তখন কি ছেলেমান্থুষই যে ছিলাম আমরা ! | দেখতে দেখতে একদিন সেই বোশেখ মাস এলো । বিয়ের তোড়- জোঁড় চলেছে । রোজই দেখি বাঁজোরিয়া সাহেব আসে! খাওয়া-দাঁওয়! করে, তারপর বাজারে যায় জিনিসপত্র কেনা-কাট। করতে । বোশেখ মাস পড়তেই কালোজামদিদি একদিন লীলাকে নিয়ে চলে গেল সাতনায়! যাবার আগের দিন বলে গেল, “লীলার বিয়েটা দিয়েই চলে আসবো । তোরা আমায় ভুলে যাবি না তো? তা এতদিন যখন সম্য হল, এ ক'টা দিনও সহ্য হবে। কালোজামদিদি মেয়েকে নিয়ে সাতনায় চলে গেল। বিয়েটা বিলিতী মতে হবে কিনা, তাই বরের বাড়িতেই গেল কালোজামদিদি । কন্তাপক্ষ ৮০ সাতনায় কী ঘটলো আমর! জানতে পারিনি । বোশেখ মাসটা কেটে গেল, তবু কালোজামদিদি আসে না। জ্যৈষ্ঠ মাসটাও কাটতে চললো, তবু আসে ন! কালোজামদিদি। আমরা মন-মর। হয়ে থাকি । কালোজাম- দিদির বাড়িতে যাই, সব ফাকা লাগে । খালি দোঁলনাট1 ঝোলে, সেটাই খানিকট। দৌলাই। ফটিক বললে, 'কালোজামদিদিকে একট চিঠি দেব ।” “ভালে! কথ! ! কিন্তু ঠিকানা কোথায় পাবি ? ঠিকানাও যোগাড় হল । কিন্তু কী লিখবে । খাতার পাতায় কেবল লিখতে লাগলাম, “কালোজামদিদি, তোমার জন্যে আমার মন কেমন করছে । পাঁতা ভি করে লিখি আর ছি'ড়ে ফেলি। লজ্জা হয়, পাছে কেউ দেখে ফেলে । কালোজামদিদির ওপর ভীষণ রাগ হল আমার ! বাজোরিয়া সাহেবের বাড়ি গিয়ে আমাদের একেবারে ভুলে গেছে । দরকার নেই। আমরাও রাগ করতে জানি! লিখবোই না চিঠি । এখানে এলে কথাই বলবো না। এবার মিষ্টি কথায় আর ভূলছি না আমরা । সেদিন রাত্রে হঠাৎ মনোহর আমাদের বাড়িতে দৌড়ে এসেছে। বাইরের ঘরের দরজায় এসে আস্তে আস্তে টোক। মারলে । বললাম, কে রে? “একবার বাইরে আয় তো, কথা আছে । বাইরে আসতে মনোহরের মুখখানার ভাব দেখে চম্‌কে উঠলাম | মনোহর প্রথমেই বললে, “ভাই, আমাদের সর্বনাশ হয়েছে ।, “কী সবনাশ ? “কালোজামদিদি বিয়ে করেছে 1, “কাকে? 'বাজোরিয়া সাহেবকে 1 মনোহরের কথাগুলে। কাপছিল। হতাঁশ হয়ে আমাদের বাড়ির সদর দরজার ওপরই বসে পড়লে। সে। বললে, 'কী হবে আমাদের ? ৮১ কন্ঠা পক্ষ আমিও যেন কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না। সত্যিই» কী হবে আমাদের ! মনোহর বললে, চল্‌, হাবুলকে গিয়ে ডাকি-_সে হয়ত কিছু বুদ্ধি দিতে পারে। সেই রাত্রেই হাবুলের কাছে গেলাম। সে সব শুনে বললে, জ্যাঠা- মশাই খবর পেয়েছে ? মনোহর বললে, “নিশ্চয় পেয়েছে ॥ 'আর লীলা? কাঁলোজামদিদির মেয়ে সে? প্রথমে টের পাওয়া যায়নি । ক'দিন থেকেই পাখিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছিল না। হাঁবা-গোবা ছেলে, কোথায় গেল সে। রাস্তা-ঘাট চেনে না। চারিদিকে খোঁজ-খবর নেওয়া হল। পুলিশে খবর দেওয়া হল। শেষে বাগানের মালিই দেখতে পেলে, পাখিটা বাড়ির মজা! কুয়োর মধ্যে মরে পড়ে আছে। আমরাও আশ্চর্য হলাম বৈকি! কালোজামদ্িদির কাণ্ড দেখে সে-ও বুঝি লজ্জা ঢাকবার আর জায়গ! পায়নি। খবরটা শুনে পঞ্চ বললে, 'বেশ হয়েছে-_খুব হয়েছে-+ আরো ভীবণ খবরট ছ-তিন দিন পরে এল ! লীলা, মিশনারী স্কুলে পড়া মেয়ে লীলাও, মার কাণ্ড দেখে নাকি গলায় দড়ি দিয়েছে। আমাদের বাক্রোধ হয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগলো, কেন: কালোজামদিদি বিয়ে করতে গেল বাজোরিয়া সাহেবকে । আমাদের নিয়ে কি কালোজামদিদির স্থখে দ্রিন কাটছিল না। কালোজামদিদির জন্যে আমার যেন কেমন মায়া হতে লাগলো | মনোহর কিন্তু বললে, “বেশ হয়েছে--খুব হয়েছে যেমন আমাদের: মনে কষ্ট দেওয়া ! আমি কিন্তু তবু কাউকে না বলে চুপি-চুপি এক এক দিন কালোজাম- দিদির ফাক] বাড়িটায় যাই। বাথরুমটা থেকে সে-রকম গন্ধ আর আসে ৬ কন্ঠাপক্ষ ৮২ না। আর ছুধের সর দিয়ে কমলালেবু বাটে না ছুখমোচন। দোলনাট। বারান্দার মাঝখানে স্থির হয়ে আছে । সব যেন কেমন হতবাক্‌ হয়ে গেছে। শুধু উকি মেরে দেখি, জ্যাঠামশাই তাঁর ঘরে খাটের ওপর চিতপাত হয়ে শুয়ে আছেন ! ওইসব দুর্ঘটনার পর আর ওঠবার শক্তি নেই যেন তার। কালোজামদিদির অন্তর্ধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দলটাও যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আমরাও আস্তে আস্তে বড় হলাম। মনও আমাদের বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। সমস্যা বাড়তে লাগলো । কেউ কেউ ফেল্‌ করলাম জীবনে, কেউ মাথা উচু করে দীড়ালাম সংসারে । ছোটিবেলাকার ছোট ছোট শখ, ছোট ছোট সাঁধ কোনোদিন পুর্ণ হয়নি বলে আর কোনে! ক্ষোভই রইল না৷ পরবর্তাঁ জীবনে । বাস্তব পৃথিবীর মুখোমুখি দাড়িয়ে নতুন দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম সব। মানে বদলে গেল সব জিনিসের। মূল্যমানের পরিবর্তন হল। আমাদের দল ছিল এক, হল বহু। কারোর সঙ্গে অন্য কারোর মতে মেলে না আর। কলকাতায় এসে আবার নতুন বন্ধুর দল জুটে গেল। সেই হট্টগোলের মধ্যে ছোটবেলাকার স্বপ্ন 'কালোজামদিদি' যে তলিয়ে যাবে তা আর বিচিত্র কী ! আমি ছিট্কে এসেছিলাম কলকাতায় । একবার যেন খবরও পেয়ে- ছিলাম-_বাজোরিয়া সাহেব মারা গেছে, কালোজামদিদি আবার বিধব। হয়েছে, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ও ছিল না, ইচ্ছেও ছিল না তখন। সে-ও প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর হয়ে গেল। কিন্ত এতদিন পরে, যখন স্মৃতি থেকে কালোজামদিদি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছে, মনোহরের সঙ্গে দেখ। হতেই আবার সব মনে পড়ে গেল। হাব-ভাব দেখে মনে হল, মনোহর বেশ স্থখেই আছে। কোনো ভাঁবনা-চিন্তা নেই। একটার পর একটা জিনিস আসতে লাগলো । মনোহর খেয়েই চলেছে! তারপর আমার দিকে চেয়ে বললে, “কন খাচ্ছিস না বল তো-_কালোজামদিদির টাক। বলে ? ৮৩ কন্তাপক্ষ আমি এর কী উত্তর দেব! বললাম, “না, তা নয়-_-১ মনোহর বললে, “এ টাক। একরকম আমারই বলতে পারিস-__কাঁলো- জামদিদি যে উপকার পায় আমার কাছ থেকে, তার তো। একটা দাম আছে! “কিসের উপকার ? জিগ্যেস করলাম । মনোহর ষেন নিজের মনেই বলতে লাগল, “তা ছাড়া, কালোজামদিদির অত টাক! খাবে কে? ছেলে আছে, না মেয়ে আছে? বাবার সমস্ত সম্পত্তি আর বাজোরিয়া সাহেবের সম্পত্তি, সব সে পেয়েছে । জববলপুরে নেপিয়ার টাউনে যদি যাস কোনদিন তে। সে-বাড়ি দেখে চিনতে পারবি ন] _-সে এক বিরাট মাবেল প্যালেস ।” এতক্ষণে খাওয়। সেরে মনোহর গেলাস নিয়ে বসলো । বললে, “তা ভগবান সত্যি সত্যি আছে ভাই, সেই ছোটবেলায় আমাদের যেমন কষ্ট দেওয়া, তেমনি এখন ভূগছে খুব ।* বললাম, “সে কী? কালোজামদিদির অস্থুখ নাকি ? “সে এক অদ্ভুত অন্ুখ ভাই, আজ সাড়ে চার বচ্ছর কালোজামদিদি ঘুমৌয়নি। কোনও ডাক্তার আর কোনও ওষুধ বাকি নেই। গেল বছরে স্থইজারল্যাণ্ডে গিয়েছিল, কিন্ত যে-কে সেই। মোটে ঘুম আসে নাঁ_ ডাক্তাররা বলে, এ-রোগ সারবে না। তবে একটা কাজ করলে অনেক দিন বাঁচবে আরো দিন-রাত কমবয়েপী ছেলেদের সঙ্গে মিশতে হবে। কিন্তুরা সাদিন-রাত ওই ছেষট্টি বছরের বুড়ীর সঙ্গে কে মিশবে বল্‌-__কুড়ি- বাইশ বছরের বেশি হলে চলবে না আবার | আমি স্তম্তিত হয়ে গেলাম । বললাম, “সত্যি ? মনোহর বললে, “হ্যা, এর একবর্ণও মিথ্যে নয়--তাই কালোজামদিদি আমাকে রেখেছে, পাঁচশো টাকা মাইনে দেয়) আর আমারও চাকরি- বাকরি ছিল না, একটা হিল্লে হ'য়ে গেল। আমি ছোকরাদের যোগাড় করে আনি, তার! দিন-রাত কালোজামদিদিকে ঘিরে থাকে সব সময়, কালোজামদিদি বুঝতে পারে সব, তাই রেট বেঁধে দিয়েছে, দিনের বেলা পাচ টাকা করে আর রাত্রের জন্যে দশ টাকা-_রাত্তির বেলাতেই কষ্ট কন্তাপক্ষ ৮৪ কি না! কালজামদিদি দোলনায় বসে থাকবে আর সবাই দোলাবে, কিংবা তাস খেলবে, গল্প করবে--তবে কুড়ি-বাইশ বছরের কম বয়স হওয়া চাই ছেলেদের ! “এরকম কত ছেলে আছে? “তা জন কুড়ি-পঁচিশ হবে, সবাই কি থাকতে চায়, _বুড়ীর সঙ্গে সারা- দিন থাকা, এও একটা পাপ বৈকি ! আমি ব্যাচ-সিস্টেম করে দিয়েছি-_ রাত্রের ব্যাচ, দিনের ব্যাচ আলাদা আলাদা ।: মনোহরের দ্রিকে নির্বাক্‌ হয়ে চেয়ে রইলাম । কী প্রচণ্ড শাস্তি কালো- জামদিদির ! ভাবতে গিয়েই কালোজামদিদির ওপর কেমন মায়! হচ্ছিল । রাত হয়ে আসছে । যাবার সময় মনোহর বললে, আসছে শনিবার কালোজামদিদির জন্মদিন, কী উপহার দেওয়া যায় বল্‌ তো? উপহারট। কিনতেই কলকাতায় আসা।, কত দামের মধ্যে ? ধর, হাজার টাকার মধ্যে 1, চমকে উঠলাম । এত টাকার উপহার দেবে মনোহর ! মনোহর হো-হে! করে হেসে উঠলো, “আরে, টাকা কি আমার নাকি ? উপহার দেবার জন্যে কালোজামদিদিই যে টাক দিয়েছে । বলে দিয়েছে, _এমন জিনিস দিবি যেন দশজনে ভালো বলে । আর শুধু কি আমাকে একল। ? কালোজামদিদি সকলকে টাকা দেয়--গাঁটের পয়সা খরচ করে কে আর ওই বুড়ীকে উপহার দিতে যাবে বল্‌-_-কেউ তো। আর পাগল নয় ?' আর একট ট্যাক্সি ডেকে উঠতে যাচ্ছিল মনোহর । বললাম, “আর একটা কথ বিয়ে-খা করেছিস তুই ? মনোহর সাপ দেখে জীতকে ওঠার মতে। ভঙ্গী করে বললে, “ওরে বাবা, তা হলে চাঁকরি চলে যাবে আমার !, গল্পট! শুনে সোনাদি সেদিন কিছু বলেনি প্রথমে । জিগ্যেস করলাম, “কেমন লাগলো, সোনাদি ? ৮৫ কণ্ঠাপক্ষ সোনাদ্দি বললে, “এত অল্প বয়সে বিকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস, কিন্ত বিকৃতিটাই তে মানুষের প্রকৃতি নয়। বিকৃতি হল প্রকৃতির বিকার । লেখকের যখন দৃষ্টি খণ্ডিত থাকে তখনই সে এইরকম বিকৃতি নিয়ে মাথ! ঘামায়। একে বৈচিত্র্য বলে ন-। একে বলে পশ্বাচার। বড় হয়ে তন পড়লে বুঝবি শক্তি-উপাসনা মোটামুটি ছু'রকমের। এক বীরাচার আর ছুই পশ্বাচার। লেখকদের মধ্যে এই ছুই রকমের জাত আছে। কিন্তু তুই বার সাধক হতে চেষ্টা কর। তবেই নাম হবে। বড় বড় লেখকদের লেখ পড়তে হবে । শুধু নিজের চরিত্র দেখে বেড়ীলেই, চলবে না। যট্‌চক্রভেদ শিখতে গেলে যে গুরু চাই 1***, এমনি কত উপদেশ দিত সোনাদি। চুল এলিয়ে দিয়ে ইজিচেয়ারে বসে বসে আপন-মনে বলে যেত সোনাদি আর আমি চেয়ে দেখতাম আর শুনতাম । বলতো, নজর রাখবি বৃহতের দিকে, ভূমার দিকে । সাধকের সঙ্গে লেখকের কোন তফাত নেই। যে-লেখকরা সাধক হতে পেরেছে তারাই ধষি। মুণ্ডতকোপনিষদে আছে বিছতে হদয়-গ্রন্থিশ্চগ্যন্তে সবসংশয়াঃ। ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তশ্মিন্‌ দৃষ্টে পরাঁবরে ॥ যে ব্রহ্ম দেখতে পেয়েছে তার অবিষ্ভা চলে যায়, তখন আর কোনও মায়া থাকে নাতার। তখন রামপ্রসাদের মতে। সে বলতে পারে-- ইহ জন্ম পর জন্ম ' বহু জন্ম পরে রামপ্রসাদ বলে আমার জন্ম হবে না জঠরে । ছান্দোগ্য উপনিষদে দেখা যায় শ্বেতকেতু পিতাকে জিগ্যেস করেছিলেন-_ যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবতি অমতং মতং অবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতমিতি কথং থু ভগবঃ স আদেশো ভবতীতি-_ | হে ভগবান, কী-সে জিনিস য। জানলে আর কিছু অজ্ঞাত থাকে না 1... সোনাদি দর্শন-শান্ত্র পড়েছিল বাঁবার কাছে কত বছর ধরে। স্বামীনাথ বাবুর সঙ্গে বিয়ে হবার আগে সোনাদি কেবল পড়াশোনা নিয়েই মেতে কন্ঠাপক্ষ ৮৬ ছিল। বিশ্বেশ্বরবাবু নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন একমাত্র মেয়েকে । আজমীরের শুকনে হাওয়ার সঙ্গে তাল রেখে গড়ে উঠেছিল সোনাদি। কিন্তু তা বলে মনের রসকষ শুকিয়ে যায়নি একেবারে । বেদ উপনিষদের সঙ্গে সঙ্গে কোথায় এক বিচিত্র বিশ্বাস মনের সমস্ত ভিত্তিমূলকে একেবারে সুদৃঢ় করে তুলেছিল । সেখান থেকে যেন নড়চড়ের কোনো ভয় ছিল না আর। ছোটবেলাকার সেই শিক্ষা, অপরিণত মনের সেই গ্রহণ, সারা-জীবনের সঙ্গে একেবারে জড়িয়ে গিয়েছিল । বিয়ে হল, তবু সে-বিশ্বাস বদলালে। না কোনদিন । বিশ্বেশ্বরবাবু মারা যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন, 'অভেদে ভেদ না-দেখে ভেদের মধ্যে অভেদকে দেখবে মা, কেবল বাদীর দর্শন ভেদেই তার যা ভিন্ন ভিন্ন বূপ-_- বিয়ের পর স্বামীনাথবাবু একদিন বললেন, “এখানে কি তোমার অস্থুবিধে হচ্ছে ? নতুন বধূ বললে, “অসুবিধে হবে কেন ?” কাল রাত্রে দেখলাম তুমি ঘরে শুতে আসোনি ।, পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে গেল, তারপর ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম-_তুমি কি রাগ করেছিলে ? “না, প্রথমে খেয়ালই হয়নি, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নজরে পড়লো আমি একলা শুয়ে আছি ঘরে ।, “একলা শুতে যদি তোমার সুবিধে হয় তো, আমি না-হয় দক্ষিণের ঘরেই শোব এবার থেকে ।, স্বামীনাথবাবু বললেন, “দক্ষিণের ঘরে যদি শোও তো মশারিটা! ভালো করে গুজে দিয়ো চারদিকে, ও-ঘরে একটু মশা আছে ।, | 'ঘুমোব আর কতটুকুই বাঁ, বই পড়তে-পড়তেই তোর রাত তিনটে বেজে যায়।? “রাত জেগে পড়া কি ভালো ? “আমার যে রাত জেগে পড়াই অভ্যেস।: এ কন্ঠাপক্ষ 'অভ্যেসটা। ত্যাগ করতে চেষ্টা করো, ওতে শরীর খারাঁপ হয় ।, এমনি করেই সূত্রপাত হয়েছিল। খুব সহজ স্বাভাবিক আরম্ত। ঠিক বিরোধ নয়। আবার যেন ঠিক অন্থুরাগও নয়। বাইরের লোক যে দেখতো সে-ই অবাক্‌ হয়ে যেত। ননদরা বলতো হ্য। বৌদি, দাদা না-হয় মাটির মানুষ, কিন্তু তোমার আকেলখানা কী ? সোনাদি বই থেকে মুখ তুলে বলতো, “কিসের আকেল, ঠাকুর-ঝি ? “তোমার বই পড়তে এত ভালোও লাগে ! আমাদেরও তো বিয়ে হয়েছে, আমরাও তো বই পড়ি, কিন্তু বিয়ে হবার পর-"" সোনাদি বলে, “কিন্ত এ-সব বই তে। তোমার দাদারই কিনে দেওয়া |” তুমি বই পড়তে ভালোবাসো দাদা জানতে পেরেছে, তাই-**কিন্তু তা বলে সারাদিন বই মুখে দিয়েই থাকবে ? “এ-বইটা যদি পড়ো ঠাকুর-ঝি তো! তুমিও নাওয়া-খাঁওয়া! ভুলে যাবে, এমন বই 1, 'আমাঁদের সংসার-ধর্ম আছে বৌদি, আমাদের বই নিয়ে থাকলে চলে না।' সোনাদি হেসে উঠলো, 'আর আমার বুঝি সংসার-ধর্ম নেই ?” 'সংসার-ধর্ম থাকলে আর এমন বই নিয়ে মেতে উঠতে পারতে না,.." তা দাদার সঙ্গে তোমার ক'দিন কথাবার্তা নেই শুনি ? “ওমা, সে কী কথা, এই তো পরশুদিন কথা বললাম |, স্বামীনাথবাবু সেদিন অফিস থেকে আসতেই সোনাদি বললে, 'ঠাকুর-ঝি কি বলছিল জানো, তোমার সঙ্গে নাকি আমার ঝগড়া হয়েছে, কথা না বললেই যেন ঝগড়া হতে হবে_ স্বামীনাথবাবু বললেন, “ওদের কথায় কান দিয়ো না।” “কিন্ত তুমিই বলো না, তুমি কি এতে রাগ করো ? স্বামীনাথবাবু হাসতে হাঁসতে বললেন, আমাকে দেখে বুঝতে পারো না, আমি রাগ করি কিন! ? কন্তাপক্ষ ৮৮ সোনাদি বললে, “তুমি ওদের সকলকে তাহলে বলে দিয়ো যে তুমি এতে রাগ করো না_-ওরা কেন বোঁঝে না, ওদের বোঝাতে পারো না যে তোমার এতে অমত নেই ? “আচ্ছা, আমি বুঝিয়ে বলবো ওদের, কিন্তু ওর! কি বুঝবে? সেইদিন থেকে জব্বলপুরের একটি সংসারে স্বামী-স্ত্রীর এক অদ্ভুত দাম্পত্য-জীবন সুর হল। সোনাদি স্বামীনাথবাবুর স্ত্রী! তবু এক শধ্যায় শয়ন না করলেও কিছু আসে যাঁয় না ওদের । স্বামীনাথবাবুর সঙ্গে যেদিন দেখা হয়, বলে, “তোমাকে যেন বড় রোগ! দেখাচ্ছে আজ-_ স্বামীনাথবাবু সংক্ষেপে বলেন, অফিসে বড় খাটুনি পড়েছে কিনা আজকাল । “অত না-ই বা খাটলে ?? “না খাটলে কি চলে? “রাত্রে ঘুম হয় ভালো ? ঘুমের ব্যাঘাত হবার তে। কোনও কারণ নেই, একবার শুলে কখন যে আমার রাত পুইয়ে যায় টেরও পাইনে |, তাহলে খাওয়া-দাওয়া ভালে। করে করো, ছুধটা তোমার আরে বেশি করে খাওয়। উচিত দুধ তো৷ খাই 1 “তবে কিছুদিন ছুটি নিয়ে কোথাও চেগ্রে যাও দ্রিনকতক ।” 'আর তুমি ?, “তুমি যদি বলো আমিও সঙ্গে যেতে পারি ।, “আমি না বললে যাবে ন। সঙ্গে ? “সেকি, আমার তো যাওয়াই উচিত, কিন্তু যদি না-ই যাই তো একলা যেয়ো না তাবলে। তাহলে অফিস থেকে একজন চাপরাসী সঙ্গে নিয়ে বরং তোমার দেখাশোনা করবে । একদিন অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরলো সোনাঁদি। নেপিয়ার টাউনে দশসাহেবের বাড়িতে গীতাপাঠ হচ্ছিল। ভাব্যকার কথা-প্রসঙ্গে বলছিলেন, ৮৯ কন্তা পক্ষ 'জীব কী অনু, না বিভূ? জীব কি ব্রন্মের অংশ, না ছায়া? জীব কী ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন, না অভিন্ন? আমাদের দর্শনশান্ত্রের এ এক মূল সমস্যা, মেনাককে যদি লেখনী করি আর সমুদ্র-জলকে মসিরূপে ব্যবহার করি তবু এর মীমাংসা হয় না ্রন্মস্থত্র বলছেন--অংশো! নানাব্যপদেশাৎ... অথচ গীতা বলছেন,_-অবিনাঁশি তু তদ্‌ বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্‌... আবার উপনিষদ বলছেন,__-একই তৃতাত্বা ভূতে ভূতে অবস্থিত রয়েছেন। জলে চন্দ্রের ছায়ায় মতো একই তিনি বহুরূপে দৃষ্ট হচ্ছেন:*৭ ননদরাও শুনছিল। এক সময়ে বললে, চলে! বৌদি, সংস্কৃতের কিছু মাথামুণড বুঝছিনে, বাড়ি গিয়ে বরং ঘুমোলে কাজ হবে ।, কিন্ত সোনাদির খুব ভালো লাগছিল ! বললে, আর একটু শোনো না ঠাকুর-ঝি, বড় ভালো লাঁগছে।” সোনাদির মনে হচ্ছিল ষেন সে বাবার কাছে বসে গীতার ব্যাখ্য। শুনছে । এমনি করে বাবার কথা শুনতে শুনতে কতদিন বিভোর হয়ে গেছে! কতর্দন সংসার, সমাজ, খাওয়া-দাওয়া ভূলে গেছে বাবার পড়। শুনতে শুনতে । ননদরা বললে, তবে তুমি থাকো! বৌদি, আমর! আসি-, কখন ননদরা চলে গেছে। সভার সব লোক চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত বুঝি দাশসাহেব একলা বসে ছিলেন। তা দাশসাহেব নিজের গাড়ি করেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেদ্িন। বাড়িতে এসে যখন পৌছুলে। সোনাদি, তখন রাত প্রায় বারোটা । সমস্ত আবহাওয়া নিঝুম । বাগানের গেট খুলে যখন ঢুকলো তখনও সোনাদির খেয়াল নেই রাত ক'টা বেজেছে। দরজ1 খুলে দিয়ে ননদ বললে, "হ্যা, বৌদি, এত রাত্তির করতে হয় ?" “রাত ক'টা ?' দেখে না ঘড়ির দিকে চেয়ে স্বামীনাথবাবু ঘুম থেকে জেগে বললেন, “ঠাণ্ডা লাগেনি তো তোমার ?” সোনাদি বললে, “না ।! কন্তাপক্ষ ৪৬ পুঁটুর তখন এক বছর বয়েস। সোনাদি বললে, “পটু তাহলে তোমার কাছেই থাক্‌।, স্বামীনাথবাবু বললেন, থাক্‌ না৷ আমার কাছেই, তুমি শুয়ে পড়োগে যাও-_ দাশসাহেবের বাড়িতে আজ গীতাপাঠ, কাল কথকতা, পরশু রামায়ণ পাঠ। দাঁশসাহেব অবশ্য ও-সব ধর্ম-কর্মের ধার ধারেন না। দাশসাহেবের স্ত্রীর অন্থুরোধেই এই সব অনুষ্ঠান হত। কিন্তু সেই স্ত্রী-ই একদিন মারা গেল হঠাৎ ছু'টি ছেলে-মেয়ে রেখে সংসারকে একেবারে ।অনাথ করে দিয়ে। সেই অনাথ সংসারের হাল ধরতে এল সোনাদি। রতি বলে, আজ তোমার কাছে শোব মা আমি ।” শিশু বলে, আমাকে বেড়াতে নিয়ে চলো না মা তোমার সঙ্গে ৷” প্রথম প্রথম পালিয়েই আসতো সোনাদি। রতি আর শিশু দেখতে না! পায়। অভিলাষ তখন থেকেই ছিল। ভুলিয়ে-ভালিয়ে সে-ই আড়ালে নিয়ে যেত। দাশসাহেবের গাড়ি নিঃশবে বাড়ি পৌছিয়ে দিত সোনাদিকে । দাঁশসাহেব বলতেন, “তোমার তো দেখছি ভারি অস্থবিধে হল | “না, অস্থবিধে আর কী ? “কিন্ত তোমাকে “মা” বলে ডাকতে শেখালে ওদের কে ? “ছেলে-মেয়েদের মা বলতে শেখাতে হয় না_আমি তিনজনেরই মা ০ “কিন্ত রাত্তির বেল তোমাকে যে এখানে থাকতে বলে ওরা) স্বামীনাথ- বাবু কী ভাবছেন কে জানে- “$কে তাহলে তুমি খুব চিনেছ 1, “এই যে এ-বাড়িতে এতক্ষণ কাটাঁও, উনি কিছু বলেন না? “বাড়িতে থাকলেই কি আমার সঙ্গে চবিবশ প্রহর দেখা হয় ? সেদিন স্বামীনাথবাবু বললেন, “কদিন তোমাকে দেখিনি মনে হচ্ছে ? সোনাদি বললে, “আমি তো বাড়িতে তিন দিন আসতেই পারিনি । $ও3+ | ৯১ কন্াাপক্ষ তবু স্বামীনাথবাবু জিগ্যেস করলেন না, এ-তিনদিন কোথায় ছিল সোনাদি। কী এমন রাজকার্ধ ! সোনাদি নিজেই বললে, “রতির বড় অস্তথুখ করেছিল জানো ?? স্বামীনাথবাবু শুধু জিগ্যেস করলেন, “এখন কেমন আছে ? খানিক পরে স্বামীনাথবাবু বললেন, “এমাসে প্রিমিয়ামের টাকাটা এখনও পাঠানে। হয়নি, চিঠি এসেছে একট1।, সোনাদি বললে, আমি আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি।” 'আমি আজকে কী খাবে? “তোমার শরীর খারাপ নাকি ? “মাথাটা ধরেছে সকাল থেকে, ছাড়ছে না৷ মোটে ।' ওদিকে দাশসাহেবের লোকও চিঠি নিয়ে আসে £ “রতি তোমাকে দেখবার জন্যে বায়না ধরেছে বড়, একবার এলে আমি অফিস যেতে পারি--, সংসারের সম্বন্ধে কয়েকটা খুটিনাটি বিষয়ে উপদেশ দিয়ে তখনি সোনাদি চলে আসে দাশসাহেবের বাড়িতে। দাশসাঁহেব বলেন, আজ আমার অফিস যাওয়াই হল নাঁ।, “এখন তে। আমি এসে গেছি, এখন যাও ।” “এত দেরি করে আর যাবে না অফিস কামাই কোরো ন মিছিমিছি, যাও গাড়ি বার করতে বলছি আমি ।' না-ই বা গেলাম ।, “না, তোমায় অফিস যেতেই হবে ।, এমনি করে এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠলো! জববলপুরের নেপিয়ার টাউনের ছু'টে। বাড়ির সঙ্গে। সাতদিন দাশসাহেবের বাড়িতে কাটলেও স্বামীনাথবাবুর কোনও অস্বস্তি হবার কথা নয়। সোনাদি স্বামীনাথবাবুরই স্ত্রী, তা সে নিজের বাড়িতেই থাকুক আর পৃথিবীর যেখানেই থাকুক । আর দাশসাহেব? কাছে পেলেই কি সম্পূর্ণ পাওয়। হয়! এক ছাদের তলাতে থাকলেই কি একাত্ম হওয়া যায়? সোনাদি দূরে গেলেও যেন কন্াপক্ষ নিই কাছে থাকে, কাছে রেখেও যেন ছুর্লভ মনে হয় সোনাঁদিকে ! সত্যিই তো৷ অখণ্ডকে যে জানতে পেরেছে, খণ্ড দেখে তো ভয় পাবার কথা নয় তার। সোনাদি বলতো, উর্বশীর মতো! একটা চরিত্র আকবার চেষ্টা কর তো। দেখি, যে কারোও মাতা নয়, কন্তা নয়, বধূ নয়_কিছু নয়! বিক্রমোর্ধশী পড়েছিস ? পুরুরবাঁর সঙ্গে উর্বশীর সেই সম্পর্ক__মনে আছে ? পণ্ডিত হরপ্রসাদ শান্ত্রীর লেখায় পড়েছিলাম £ উর্বশী কল্পনার সঙ্গিনী মানসের রঙ্গিণী, কবিরা যাকে রস বলেন সেই রসের খর-প্রত্রবণ | মনে হত সোনাদি যেন নিজের কথাই বলতে চাইছে । আমি যাদের দেখেছি, যাদের কথা লিখেছি-_-সব যেন সাধারণ মেয়ে সব। ওই সুধা সেন, অলকা! পাল, মিষ্টিদিদি, মিছরি বৌদি, মিলি মল্লিক-_সবাই তুচ্ছ। সোনাদি আমার একটা গল্পও তাই ভালো বলেনি কোনদিন। কিছু পছন্দ হয়নি সোনাদির কখনো । বলতো, “বুহতের দিকে নজর রাখ, দৃষ্টি রাখ ভূমার, দিকে, দৃষ্টি রাখ মহাভারতের দিকে । উপন্যাস যদি লিখতেই হয় তো মহাউপন্যাস লিখবি- অখণ্ড যার পরমায়ু। নইলে বছরে ছু'টো করে বই লিখবি আর বছর না কাটতেই সব ভূলে যাঁবে লোকে, তবে আর কিসের জীবন-শিল্পী !' আমিও ভাবতাম-_এত চরিত্র দেখেছি বলে আমার মিথ্যেই গর্ব সত্যিই যে উর্বশীকে দেখতে পেয়েছে তার কাছে সব নারী-চরিত্র তো ম্লান। তাই মিছরি-বৌদির গল্পটা লিখবো-লিখবো করেও আর লিখিনি ! অথচ মিছরি-বৌদিকেই একদিন মনে হত কত বিচিত্র চরিত্র! অমরেশের বউ-_সেই মিছরি-বৌদি। মিষ্টিদিদির গল্প তো৷ আপনারা শুনেছেন । এবার আর-একজনের গল্প বলি--সে আমার মিছরি-বৌদ্ির গল্প । মিছরি-বৌদি কিন্তু আমার সাত কুলের কেউ নয়। আপন বৌদি তে! দূরের কথা, দূর সম্পর্কেরও বৌদি নয়। মোট কথা মিছরি-বৌদিকে আমি জীবনে ছু'বারের বেশি দেখিওনি । তবুও মিষ্টিদিদির কথায় মিছরিবৌদির কথা আমার প্রায়ই মনে পড়তো । কোথায় যেন মিষ্টিদিদির সঙ্গে মিছরি-বৌদির একট! মিলও ছিল। হয়ত ৯৩ কন্ঠাপক্ষ সে-মিল তাদের চেহারায়। মিষ্টিদিদির মত মিছরি-বৌদিও ছিল পাতলা ছিপছিপে রোগা । মনে হত ফু দিলে উড়ে যাঁবে বুঝি । মনে হত ছু'পা ইাঁটলেই বুঝি হার্ট-ফেল্‌ করবে । মনে হত--আর ক'দিনই-বা বাচবে.... - একদিন একটু জ্বর হলেই মিছরি-বৌদি মাঁরা যাবে হঠাৎ | অন্তত অমরেশ মিছরি-বৌদিকে নিয়ে যা করতো-_আমার তো রীতি- মতে! ভয় হয়েছিল ! অমরেশ ছিল গুণ চেহারার মানুষ । বলতো, “এই দেখ, মিছরিকে নিয়ে কেমন লোফালুফি খেলি । এই দেখ--এক-_ছুই-_-তিন-_ আমার অন্তরাত্মা তখন শুকিয়ে গেছে। মিছরি-বৌদিও কম ভয় পায়নি। মিছরি-বৌদিকে টপ. করে চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে লোফালুফি সুরু করে দিত অমরেশ। একটু যদি হাত ফস্কে যায় তো, মিছরিবৌদির ওই শুকনো হাড় ক'খানা আর আস্ত থাকবে না তাহলে। বলতাম, 'থাম্__থাম--করিস কি অমরেশ ! থাম 1, মিছরি-বৌদিও তখন বেশ ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। কাপড়চোপড় নিয়ে ব্যস্ত। মাথার ঘোমট। খসে গেছে । খোঁপা খুলে গেছে । অমরেশের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলে বাঁচে যেন। বললে, “দেখলেন তো। ঠাকুরপো-_দিনরাত এই রকম ! যদি পড়ে যেতুম- অমরেশ তখন হাতের মাস্ল্‌ ছুটে! ফোলাচ্ছে। বললে, পড়তেই যদি যাবে তো চেহারাটা বাগিয়েছিলাম কেন? এতদিন মাখম, ডিম, ছোল। খেয়েছি কি শুধু মিছিমিছি ? তাই এই মিছরি-বৌদিকেই বহুদিন পরে একদিন দেখলাম জব্বলপুর স্টেশনে । জববলপুর স্টেশনে বন্ধে মেল থেকে নেমে ছোট লাইনের গাড়িতে উঠবো । তাড়াতাড়ি করছি । হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে বললে, ঠাকুরপো না £ ফিরে চাইলাম। কিন্তু সামনে যাঁকে দেখলাম তাকে আমার চিনতে পারার কথা নয়। বেশ মোটাসোটা মেয়ে। মাথায় আধঘোমটা | হাতে কন্তাপক্ষ ৯৪ একট এন্ব ম্ডারি-করা ব্যাগ । ফরসা, মাজাঘষা রঙ । আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমার মুখ-চোখের ভঙ্গী দেখে বললে, “এরি মধ্যেই ভূলে গেলেন নাকি মিছরি-বৌদিকে ? মিছরি-বৌদি ! আমি সবিস্ময়ে আর একবার চেয়ে দেখলাম। কিন্তু আমার চেনা মিছরি-বৌদির সঙ্গে এ চেহারার মিল নেই কোনখানে। কেমন যেন হতবাক্‌ হয়ে গেলাম । এমন তে। হবার কথা! নয়। এমন পরিবর্তন তো হয় না মানুষের । মিছরি-বৌদি তখন হাসছিলো ৷ বললে, "আমার বাড়িতে চলুন আজকে আর কোথাও যেতে পাবেন না ।' মিছরি-বৌদি কাদের বুঝি ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলে । বললাম, “আমার যে জরুরী কাজ ছিল একটা ।, তা থাকুক কাজ'_ ব'লে আমাকে টেনে নিয়ে চললে! । আমি কিন্তু তখন অন্য কথ ভাবছি । অমরেশ অবশ্য চিকিৎসা করাতো মিছরি-বৌদির। দেখেছিলাম মিছরি-বৌদির টেবিলে অনেক রকম ওষধের শিশি। অনেক রকম লিভার এক্স্া্ট। অমরেশ বলতো “মনটা খুশি রাখতে পারলেই মিছরির শরীরট। চড় চড় করে সেরে উঠবে ।, তা মিছরি-বৌদির মন প্রফুল্ল রাখবারই কি অমরেশ কম চেষ্টা করেছে ! বাগানে দোলন। টাঁডিয়ে দিয়েছে । সে দোলনাও আমি দেখেছি । কিন্তু অমরেশের তে কাণ্ড । দোল দিতে দিতে অমরেশ এমন জোরে দোল দিত যে, মিছরি-বৌদির বুক তখন কাঁপছে থরথর করে। নামতে পারলে বাঁচে। মিছরি-বৌদি বলেছিল, "দেখছেন তো ঠাকুরপো, আপনি না' থাকলে আমি আজ মরেই যেতাম । আমি সেবার বলে এসেছিলাম, খুব সাবধানে থাকবেন বৌদি__ 'অমরেশ সব পারে !, ৯৫ কণ্ঠাপক্ষ অমরেশকে আমি চিনতাম ছোটবেলা! থেকে । মিত্র ইনষ্টিটিউশন্‌ থেকে এক ক্লাসে পড়ে একসঙ্গে ম্যাটি.ক পাশ করেছিলাম ছুজনে। অমরেশকে চিনতে আমাদের আর বাকি নেই। কতদিন কতবার অমরেশের কত ঘুষি, কত কিল খেয়েছি তার আর হিসেব-পন্তোর নেই। অথচ আদর করেই করতো সে-সব। অমরেশের আদরের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম ছোটবেলায় । হঠাঁং হয়ত আদর করেই পিঠে একটা ঘুষি মেরে বললে, “কিরে, কোথায় যাচ্ছিস? কিংবা হয়ত হাসির গল্প করতে করতে খুব ফুতি হয়েছে অমরেশের, হঠাৎ ফুত্তির আবেগে ছুদিকে ছুজনের পিঠে ছুই কিল মেরে হেসে গড়িয়ে পড়লো । বললো, আর হাসাস্‌ নে ভাই, দম ফেটে যাবে এবার ।, অমরেশের পক্ষে যা! ছিল খেলা, আমাদের পক্ষে তা-ই ছিল মৃত্যু-যন্ত্রণা ৷ আমর! তখন হয়ত কিল খেয়ে আর শিরদাড়া সোজ। করতে পারছি না । যন্বণায় পিঠ কন্কন্‌ করছে ! অমরেশ বলতো, “আমার মতো ছোলা খা, ছুধ খাঁ, ডিম খা, মুগ্ডর ভজ-_তোঁদেরও আমার মতো। চেহারা হবে! ও রকম দশটা কিলেও কিছু হবে না।” অমরেশের ঘরে গিয়ে দেখেছি-_চারিদিকে কেবল স্তাণ্ডো, হারকিউলিস, এ্যাপোলোর ছবি। নানারকমের চার্ট । শরীর সারাবার কৌশল লেখা সব বই। বাঁরবেল, মুগ্ুডর, ভান্বেল--এই সব! যত রকমের কলা-কৌশল আছে, সব শিখে নিত অমরেশ । ভারী ভারী লোহার বল ছু'ড়তো ৷ দেড় মণ ছু' মণ ওজনের বারবেল অনায়াসে তুলতো৷ মাথার ওপর । বলতো, “জানিস, কাল হঠাৎ স্তাণ্ডোকে স্বপন দেখেছি ।। বললাম, “স্যান্ডো ॥ হ্যারে, দেখলুম স্যাণ্ডো যেন আমার দিকে চেয়ে আছে একটদৃষ্টে। আমি স্তাণ্ডোকে দেখেই বাইসেপস্‌ ছু'টো ফুলিয়ে দিনুম | স্তাণ্ডো বললে, নসাবাস্‌ বেটা, জীতা৷ রহো।” কন্তাপক্ষ ৯৬ আমাদের কুস্তির আখড়াতে একল। অমরেশই শুধু শেষ পর্যস্ত টি'কে ছিল। টাদা করে কুস্তির আখড়া করেছিলুম সোনাদির বাগানের এক কোণে। নিমপাতা দিয়ে আখড়ার মাটি মেখেছিলুম। ভোরবেল। উঠে গিয়ে আখড়ার মাটিতে গড়াগড়ি দিতুম । প্যারালাল বার, হোরাইজেন্টাল বার, রিং--সব রকমের ব্যবস্থাই ছিল। তারপর বাড়িতে এসে কল্-বেরোন ছোলা! আর আদা-নুন খেয়ে স্নান করে ফেলতুম । সে-সব কতদিন আগেকার কথা! আমরা অমরেশের মতো চেহাঁরা করবার চেষ্টা করতুম। অমরেশ ছিল আমাদের পাণ্ডী। অমরেশের উৎসাহেই আমাদের উৎসাহ, অমরেশই আমাদের আদর্শ! মাসে একদিন হনুমানজির পুজো হতো । আখড়ার এক কোণে হন্ুমানজির মূতি তৈরি করেছিল আমাদের আর্টিস্ট জয়ন্ত । সেদিনটা আমাদের উৎসব । সকাল থেকে সি'ছুর মাখানো হচ্ছে হন্ুমানজির গায়ে। চাঁদার পয়সায় ছোল। হওয়া হত, মাখন আসতো, মর্মান কল। আসতো । অমরেশ বলতো, খুব করে ভিটামিন খাবি, তাঁতে শরীরের জোর হয়।' মনে আছে ভিটামিন কথাটা অমরেশের মুখেই প্রথম শুনি। সেই ভিটামিন খেয়ে কিন। জানি না, অমরেশের চেহার! দ্রিন দিন দৈত্যের মত হয়ে উঠলো । আমরা যে-যার দিকে ছিটকে পড়লাম। কেউ চাকরিতে, কেউ ব্যবসায়, কেউ বা দালালিতে। ভুলে গেলাম আখড়ার কথা! । কিন্ত অমরেশ স্থাস্থ্যচর্চ৷ ছাড়লে না। ক্লাবের বারবেল, ডাম্বেল, মুগ্ডর সব কিছু নিয়ে একদিন ছাঁদের ওপর তুললো, বললে, “ওটা কি ছাড়তে পারি রে-_তাতে যে বাত হবে। বললে, ণ“তোরাও ছাড়িস্নি। এখন ছেড়ে দিলে বাতে পঙ্গু হয়ে যাবি সব।' মনে আছে আমার এক দূর সম্পর্কের দাঁদ। ইনসিওরের দালালি করতো । একবার এসেছিল কিছু কেস্‌ যোগাড় করে নিতে । বললে, “তার বন্ধু- বান্ধবরা তো চাকরি-বাঁকরি করছে এখন, দে না ছু'একটা কেস্‌ করিয়ে ।, ছু” একটা পলিসি করিয়েও দিয়েছিলাম । কেউ বা স্বার্থের তাগিদে করেছিল, ৯৭ ৰ কঠাপক্ষ কেউ বা উপরোধে পড়ে । কিন্ত অমরেশের কাছে কথাট। পাড়তেই রেগে গেল। বললে, "ইনসিওর করবো কেন ?” দাঁদা বুঝিয়ে বলতে গেল, “এই তো! জীবন আমাদের! কখন আছি, কখন নেই...আপনার অবর্তমানে** কথাটা শেষ হল না। অমরেশ বললে, “মরবো৷ কি মশাই, মরে ওমনি গেলেই হল | বলে গেঞ্জিটা খপ. করে খুলে ফেলে আবার বললে, ন্বাস্থ্যটা দেখেছেন? অনেক বাঁরবেল, মুগ্ডর ভে'জে গড়েছি চেহারাটা ৷? তারপর গেঞ্সিট। গায়ে দিয়ে বললে, “অত সহজে মরছি না আমি মশাই ।, তা সেই অমরেশ শেষকালে একদিন কলকাত। ছেড়ে চলে গেল হঠাৎ । আর তার খবর পাইনি! পরে শুনলাম, সে নাকি মোরাদাবাদের এক পালোয়ানের কাছে কুস্তি শিখতে গেছে । তারপর আরে! কয়েক বছর পরে 'যখন আমি বাইরে চাকরি করছি, তখন একবার কলকাতায় এসে শুনলাম __বক্সিং-এ ট্রফি জিতেছে অমরেশ সেবার । এমনি করে কয়েক বছর পর পর একটু একটু সংবাদ পাঁই অমরেশের ! কখনও খবরের কাগজে খেলা- ধুলোর পাতায় ছবি বেরোয়, কখনও শুনি, সে লক্ষৌতে ড্রিল-মাস্টারি করছে কোন সরকারী ইস্কুলে। আবার কখনও শুনি, বোম্বেতে মিউনিসিপ্যা- লিটির চাকরি নিয়ে গেছে ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটার হয়ে । এই রকম ছাঁড়া- ছাঁড়া খবর সব। কিন্তু মনে মনে বরাবর একট শ্রদ্ধা ছিল অমরেশের ওপর। একমাত্র আমাদের মধ্যে ও-ই কেবল স্বাস্থ্যচর্চ৷ নিয়ে রইল । মনে হত বাঙালীর বদনাম ঘোচাতে পারবে বটে অমরেশ ! তারপর যেবার জব্বলপুরে গেলাম আপিসের কাজে, সেইবার হঠাৎ রাস্তায় অমরেশের সঙ্গে দেখ! হয়ে গেল। নেপিয়ার টাউনে লেভেল-ক্রসিং-এর কাছে ফ্াড়িয়ে আছি । রি. বন্ধ। ট্রেন আসছিল । কন্তঠাপক্ষ ৯৮ হঠাঁৎ পিঠের ওপর এক ভীষণ মর্মান্তিক ঘুষি ! মনে হল পিঠটা যেন আর নেই আমার! সমস্ত চোখে তখন আমি সরষের ফুল দেখছি । কোন রকমে চোখের জল সামলে সামনে চেয়ে দেখি, হো হো করে বিকট হাসি হাসছে আর কেউ নয়, আমাদের অমরেশ ! এক হাতে সাইকেলটা ধরা । বললে, “তুই এখানে ? আমারও ও-ই ছিল প্রশ্ন ! প্রশ্ন না করে ফ্যাল্‌ ফ্যাল্‌ করে অমরেশের দিকে চেয়ে রইলাম শুধু। অমরেশ এক হাত দিয়ে আমার কাধে ঝাকুনি দিয়ে বললে, “তুই এখানে কেন রে?” আমিও বললাম, “তুই ? কিন্ত এবার সরে এলাম । কাছে থাকলেই, গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা অমরেশের স্বভাব । ূ গেট তখন খুলে দিয়েছে । একটা ট্রেন ডানদিকে থেকে বাঁদিকে চলে গেল। অনেকগুলো গরুর গাঁড়ি, সাইকেল-রিকৃশী, ঘোঁড়ার গাঁড়ি আটকে ছিল এতক্ষণ । তারাও চলতে লাগলো । অমরেশ বললে, আমার বাঁউলোয় চল্‌ বললাম, “তুই এখানে কেন ?, কবে থেকে ? অমরেশ বললে, “সে-সব কথা৷ পরে হবে, তুই আমার সাইকেলের পেছনে ওঠ. 1” | বললাম, 'কতদূর ?? “বেশি না, মাইল ছয়েক ।; ছ"মাইল সাইকেলের পেছনে চড়াও যেমন বিপদ, আমার মতো! ভার নিয়ে এতখাঁনি চালানোও শক্ত। বললাম, “না, থাক। তোর কষ্ট হবে।, কষ্ট! তোকে কীধে করে দশ মাইল নিয়ে যেতে পারি জাঁনিস্‌, মুগডুর ভাজি কি মিছিমিছি নাকি? তারপর বললে, “তুই আমায় লজ্জ। দিলি সত্যি; বললাম, “এখনও যুগুর ভ'জিস্‌ তুই ?” ৯৯ কন্তাপক্ষ যাহোক, সেদিন শেষ পর্যস্ত সাইকেল-রিকৃশাতে চড়ে অমরেশের বাঙলোয় গিয়েছিলাম । নেপিয়ার টাউন থেকে গান্-ক্যারেজ ফ্যাক্টরি । রাস্তা অনেকখানি । মাঝে অনেক চড়াই উতরাই ! কিন্ত সারা রাস্তা অমরেশ আমার পাশে পাশে গল্প করতে করতে চলেছিল । বলেছিল, 'জব্বলপুরে এলি, আর আমার বাঁউলোয় উঠবি না_শুনলে মিছরি রাগ করবে যে। বুঝেছিলাম, মিছরি অমরেশের বউ-এর নাম। মিছরির কথা বলতেই অমরেশ পঞ্চমুখ । মিছরি বড় রোগ।। মিছরি যা খায় হজম হয় না।. মিছরির শরীরের ওজন। এই সব। বললে, গ্যাখ আজ পর্যন্ত কত ছেলেকে মানুষ করলুম, কত হাড়জির- জিরেকে মাস্ল্‌ ফুলিয়ে দিলুম ; কত ছেলে আগে ভাত হজম করতে পারতো না, তাদের দিয়ে লোহা! হজম করিয়ে দিলুম তার গোনাগুনতি নেই। কিন্তু মিছরিকে পারছি না। কেবল আজ অন্বল, কাল চৌয়াঢেকুর |” বললাম, “ডাক্তারে কী বলে ? তারপর অমরেশ আরো অনেক কথা বলেছিল । বলেছিল, “তা ছাড়া ও-মেয়েকে বিয়ে না করলে অমন চাকরিটা প্রায় তখন হাত-ছাড়াই হয়ে যায় শ্বশুর নিজে হল তখন ওয়ার্কস্‌ ম্যানেজার” অমরেশ রাস্তায় যেতে যেতে অনেক গল্প করেছিল সেদিন। কিন্তু অমরেশের কথা শুনে আমার যেন সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিল মনে মনে। রোগ। চেহারার ওপর অমরেশের বরাবর রাগ ছিল ! আশেপাশে ক্ষীণ- স্বাস্থ্য লোক দেখতে পারতো! না৷ মোটে । দুর্বল লোক দেখলে কিল-ঘুষি আবার বেশি চালাতো। ছুম্‌ ছুম্‌ করে ঘুষি মারতো। তার বুকের পাঁজরার ওপরে । বুক ফুলিয়ে বলতো, '্বাস্থ্য হবে এই এইরকম, এই গ্যাখ +_- বলে নিজের বুকট। ফুলিয়ে ডাবল্‌ করতো। অমরেশ। সেই অমরেশ এবার*সত্যিই জব্দ হয়েছে ভেবে খুব আনন্দ পেলাম। মিছরিকে নিশ্চয়ই ঘুষি মারতে পারবে না। মিছরির জন্যেই তার চাকরি । শুধু চাকরি নয়, ভালে! চাকরি । নইলে বাঙলে' পায়! কন্ঠাপক্ষ টির কিন্ত অমরেশের বাঙলোয় গিয়ে সে-ভুল আমার ভাঙলো । বাঙলোর সামনে সাইকেল থেকে নেমেই কিন্তু অমরেশ চীৎকার জুড়ে দিলে, “মিছরি, মিছরি---১ চাঁকর-বাঁকড় দৌড়ে এল অমরেশের সাঁড়া পেয়ে, কিন্ত যাকে ডাকা সে কিন্তু এল ন1। একজন চাঁকরকে অমরেশ জিগ্যেস করলে, “মেম-সাহেব কোথায় ? সে বললে, “বিছানায় শুয়ে আছে ।” আমাকে ঘরে বসিয়ে অমরেশ দৌড়ে ভেতরে গেল। বললে, “তুই বোস্‌। আমি মিছরিকে ডেকে আনি 1, ঘরের চারদিকে চেয়ে দেখলাম । সাহেবী কেতায় সাজানে। ঘর, এক- পাঁশে দেয়ালের গায়ে ম্যান্টেলপিসও রয়েছে । তার নিচে আগুন জ্বালাবার জায়গা । ওপরে অমরেশের নান। বয়সের ফোটোগ্রাফ। কোনোটা খালি গায়ে । শরীরের নান! অংশের মাস্ল্‌ দেখাচ্ছে অমরেশ । অনেক মেডেল ঝোলানে। গলায় । সার্টিফিকেটগুলে। ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছে । আর দেয়ালের চারিদিকে বড় বড় পালোয়ান, কুস্তিগীরদের ছবি। অমরেশের সব দেবতামণ্লী। খানিক পরে যেন মেয়েমান্ুষের গলার আওয়াজ পেলাম, “ওমা, করে! কী-_ছি ছি, করে! কী--"। দেখি, অমরেশ বউকে একেবারে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে হাজির | বললে, “দেখলি, এই হল মিছরি ।_-আর, ও হল***? আমি যতটা ন1 অগ্রন্তত হলাম, মিছরি-বৌদ্ি আরো অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। তাকে পাজাকোলো৷ করে নিয়ে অমরেশ ঘরের ভেতর ঘুরতে লাগলো । মিছরি-বৌদি বললে, “কী লঙ্জ। বলো তো ! ছাড়ে । কিন্ত মনে আছে, অমরেশ সেদিন, সেই প্রথম দিন, কী কাণ্ডই যে করেছিল ! বললে, “এই গ্ভাখ মিছরিকে লুফবো! দেখবি । ১০১ কন্ঠাপক্ষ কিন্ত আমি ঘটনাট! হৃদয়ঙ্গম করবার আগেই অমরেশ মিছরি-বৌদিকে সত্যি সত্যি লুফতে আরম্ত করেছে। বললে, “এই ছ্যাখ --এক, ছুই, তিন." আমি আর দেখতে পারলুম না। আমার বুকট। তখন ধডাস ধড়াস করছে ! মিছরি-বৌদিও তখন অন্ুনয় বিনয় করে বলছে, "ছাড়ো, ছাড়ো, পড়ে যাবো যে! ছিছি,কীতুমি! মিছরি-বৌদির মাথার খোঁপা তখন খসে গেছে! শাড়ি অবিন্তস্ত। কিন্ত সেদিকে খেয়াল নেই অমরেশের। সে তখন গুনছে, “তিন, চার পচ, আমি আর পারলাম না। উঠে দীড়িয়ে বললাম, ছাড় না অমরেশ, ওকি-_ ছাড় প্রথম দ্রিনেই অমরেশ এমন কাণ্ড করবে ভাবতে পারিনি আমি । তাহলে আঁসতামই না এখানে । দেখলাম, অমরেশ এতদিন পরেও এতটুকু বদলায়নি। গুগ্ডামির ভাবট। তার চরিত্র থেকে এখনও যায়নি । নিজের সত্রীর ওপরেও সে তেমনি নিষ্ঠুর ! মিছরি-বৌদি তখন হীঁফাচ্ছে। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে । নামিয়ে দেবার অনেকক্ষণ পরেও সেদিন মুখে কথা৷ বেরোয়নি মিছরি-বৌদির। চেয়ারে বসে পাখার তলায় অনেকক্ষণ জিরিয়ে তবে মুখে কথা ফুটলো । বললে, “দেখলেন তো ঠাকুরপো, আপনি না থাকলে আমি আজ মরেই যেতাম! মিছরি-বৌদিকে এবার ভালে করে দেখলাম । কাটির মতো পাতল। শরীর, গলায় কণ্ঠ বেরোন । গালের চোয়াল ছৃ;টোও স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ, তীক্ষ। কোথাও কোনে চখি যেন নেই শরীরে। অমরেশ বলেছিল, “দেখলি তো। ভাই, এই রকম সারাদিন-__খালি বিছানায় শুয়ে থাকবে ।, খেতে বসে দেখলাম মিছরি-বৌদি খাবারগুলো টেবিলের নিচে একটা। কন্তাপক্ষ ১০২ বাটিতে লুকিয়ে ফেলেছে । অমরেশ মিছরি-বৌদির উল্টো দিকে বসেছিল । খাওয়া দেখছিলাম আমি অমরেশের। এক প্লেট ভাত, চার বাটি মাংস, এক ডিস্‌ ফল, তারপর প্রায় ছু'সের ছুধ আর একুনে তিরিশখানি রুটি ! খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। আর এক-একবার মুখ তুলে আমাকে বলছে, “খা খা। ফেলে রাখিস্নে, সব খেতে হবে । তারপর মিছরি-বৌদিকে লক্ষ্য করে বললে, “কট! রুটি খেলে তুমি ? মিছরি-বৌদি অক্রেশে বললে, “এই তো বাঁরোখান। হচ্ছে ।, “আর মাংস % মিছরি-বৌদি অয়ান বদনে বললে, “তিন বাটি ।। অমরেশ বললে, 'আর চারখান! রুটি খেলে তবে তোমার ছুটি ।, মিছরি-কৌদি কিছু বললে না । কিন্তু দেখলাম খুব সন্তর্পণে মাংস, রুটি, তরকারি, ফল-_সমস্ত টেবিলের নিচে একটা! পাত্রে লুকিয়ে ফেলেছে । পরে আমাকে মিছরি-বৌদি বলেছিল, “ওঁকে যেন বলবেন না, তাহলে আমায় একেবারে খুন করে ফেলবেন। ষোলখানা রুটি খেয়ে কি মরবে! নাকি পেট ফুলে, ঠাকুরপো 1 'ক*খানা খেলেন সত্যি সত্যি ? “মাত্র ছুখানা। ছু'খান। খেলেই আমার পেট ভরে যায়।, খেতে খেতে অমরেশ বলেছিল, খাবে, দৌড়বে, লাফাবে-ঝাঁপাবে, হৈ হৈ করবে--তবে না লাইক, আর তা না হলে কুড়ি বছরেই বুড়িয়ে গিয়ে একদিন রক্ত-আমাঁশ! হয়ে টুপ করে মরে যাও--বাঁঙালীর তো ওই এক পরিণতি 1 মিছরি-বৌদি পরে বলেছিল, “এ আর কী দেখছেন ঠাকুরপো, আপনি এসেছেন তাই, নইলে ছুপুরবেলা যেদিন বাড়ি থাকেন, সেদিন হঠাৎ যদি খেয়াল হয়, তো ক্ষিপিং করতে হবে ওর সঙ্গে'''সে আর শেষ হতে চায় না, পাঁ হাত কন্কন্‌ করলেও রেহাই নেই, শেষকালে একেবারে আমার অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো। অবস্থা হয়» বলতে বলতে মিছরি-বৌদির যেন ভয়ে মুখ শুকিয়ে এল। টা কন্তাপক্ষ আর ওই দেখুন দোল্না, বিকেলবেলা এসেই দৌঁল্ন। চাঁপতে হবে-_ ওতে নাকি পায়ের আর বুকের জোর বাড়ে, আবার মাঝখানে একবার ঘোড়া কিনেছিলেন একটা, বললেন-_রাঁইডিংটা সবচেয়ে নাকি ভালে! একসারসাইজ 1” 'সে ঘোড়া কোথায় গেল ? “সে মরে গেল তাই, কিন্তু ক'দিন যে সে কী গায়ে ব্যথা ঘুমোতে পারি না, শুতে পারি না, দাড়াতে পারি না, বসতে পারি না সে যে কী অশান্তি! শেষে ঘোড়াটার বোধ হয় মায়া হল আমার ওপর, মরে গেল একদিন দয়! করে ।, অমরেশের ব্যাপারটা আমার বরাবরই কেমন যেন একট ব্যাধি বলে মনে হত। সব শুনে সেদিনও মনে হয়েছিল ব্যাঁধিটা! যেন বেড়েছে বৈ কমেনি। আর একট! দিন মাত্র ছিলাম জববলপুরে, কিন্ত সেই একদিনেই মিছরি-বৌদির জন্যে আমার সত্যিই মায়া হল। এমন স্বামীর হাতে পড়ে মিছরি-বৌদি নিশ্চয় একদিন মার! যাবে মনে হল । ওই শরীর নিয়ে যে কী করে বেঁচে আছে, এইটেই আশ্চর্য মনে হয়েছিল সেদিন। ওই স্বাস্থা- উদ্ধারের নামে অত্যাচার--এ অমরেশের আর একরকম চরিত্র-বিকৃতি ! ওর চিকিৎসা, সাধারণ চিকিৎসা নয়। রোগট। মানসিক। মনের নিভৃতে কোথায় যেন পোকা ধরেছে অমরেশের। আসবার দিন মিছরি-বৌদিকে কথা দিয়েছিলাম, “এদিকে এলে নিশ্চয় উঠবো আপনার এখানে মিছরি-বৌদি বলেছিল, “এলে আমাকে আর দেখতে পাবেন না ঠাকুরপোঁ, তবে আপনার বন্ধুর সঙ্গে দেখ৷ হবে ঠিকই |, মিছরি-বৌদি অব্য হাঁসতে হাসতেই কথাটা বলেছিল, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছিলাম তার মনের গোপন ব্যথাটুকু। সেদিন মিছরি-বৌদির কথায় প্রতিবাদও করতে পারিনি সেই জন্যে । জানতাম অমরেশের হাতে মিছরি-বৌদির ইহলীল। একদিন হঠাৎ অকালে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবেই শেষ হয়ে যাবে। কোনও সন্দেহ নেই আর তার! কন্টাপক্ষ ১৩৪ অমরেশ গাড়িতে তুলে দিতে আসবার সময় বলেছিল, “তুই বোধহয় ও-সব চর্চা-্টা ছেড়ে দিয়েছিস্‌, না রে ? আমি কিছু উত্তর দিইনি । খানিক থেমে অমরেশই বলেছিল, “যদি দীর্ঘ পরমায়ু পেতে চাঁস্‌ তো? একসারসাইজট। ছাঁড়িস্নে, বুঝলি ? কিন্ত তখন আমার চোখের সামনে মিছরি-বৌদ্ির জলন্ত উদাহরণটা স্পষ্ট ভেসে রয়েছে । আমি সেদিন ভালে! করে কথাই বলিনি অমরেশের সঙ্গে শেষ পধন্ত | এ-ঘটনার পর অনেকদিন কেটে গেছে। জব্বলপুরের দিকে আর যাওয়৷ হয়নি । মিছরি-বৌদির খবরও আর পাইনি। অমরেশের সঙ্গেও আর দেখ! হয়নি । এতদিন পরে আঁবার জব্বলপুর স্টেশনে মিছরি-বৌদির সঙ্গে দেখা হবার সঙ্গে সঙ্গে যেন সমস্ত ঘটনাট। মনে পড়লো । কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম দেখে__সেই মিছরি-বৌদি এমন স্বাস্থ্যবতী হল কেমন করে! তবে কি অমরেশ শেষ পর্যস্ত নিজের সিস্টেমে সব রোগ সারিয়ে দিলে মিছরি-বৌদির ! নাকি ডাক্তারের কোনো ভালে। ওষুধে কাজ হল শেষ পর্ধন্ত। সাইকেল-রিকৃশায় চলেছিলাম ছুজনে। নেপিয়ার টাউনের বাজারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মিছরি-বৌদি বললে, “এই দেখুন ঠাকুরপো, এই আমাদের ইস্কুল ।” “ইস্কুল! ইন্কুলে পড়েন নাঁকি ? “না, বুড়ো বয়সে আর পড়বো কেন? পড়াই ।, “মাস্টারি করেন ?? মিছরি-বৌদি বললে, স্থ্যা, মাস্টারিই তো । আজ সাত বছর এই এক ইস্কুলেই কেটে গেল ।, কিন্ত কথাট। শুনে কেমন যেন অবাঁক্‌ হয়ে গেলাম ! অমরেশ কি শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে দিয়ে চাকরি করাচ্ছে! তবে হয়ত চাঁকরি করছে বলেই ১০৫ কন্াপক্ষ স্বাস্থ্যটা ভালো হয়েছে মিছরি-বৌদির। সারাদিন ঘরে বসে থাকলে শরীর মন কিছুই কি ভালো থাকে? ভালোই হয়েছে, মনে মনে ভাবলাম । জিগ্যেস করলাম, “মাস্টারি আগে কি করেছিলেন কখনও ? মিছরি-বৌদি বললে, “ওমা, মাস্টারি করতে যাবে। কেন, আমারই বলে তিন-তিনটে মাস্টার ছিল, তখন বাব! বেঁচে ছিলেন-সকালে একজন পড়াতো৷ ইংরেজী, বিকেলে অঙ্ক আর রাত্রে হিস্ট্রি; কিন্ত তখন অত পড়েও দেখুন স্বাস্থ্য খারাপ হয়নি; বিয়ে হবার পর থেকেই যে কী হল-_ বললাম, “কিন্ত এখন তো! আপনার চেহারা একেবারে বদলে গেছে ।” মিছরি-বৌদি বললে, “তাই তো। আপনি আমাকে চিনতে পারেননি-_ আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনেছি, ঠাকুরপৌ। 1, একটা দোকানের সামনে এসেই মিছরি-বৌদি রিকৃশাওয়ালাকে থামতে বললে। আমাকে বললেন, 'আপনি একটু বসুন ঠাকুরপো, দোকানে একটা জিনিস কেনবার আছে আমার ।, মিছরি-বৌদি নেমে গেল। আমি ভালে। করে দেখতে লাগলাম পেছন থেকে। আশ্চর্য! চেনাই যায় না আর সেই আগেকার মিছরি-বৌদিকে। সার শরীরে আগে যেখানে তীক্ষতা ছিল, এখন সেখানে নিটোল নিভাজ লাবণ্য । সুডৌল, পরিপূর্ণ, নরম মিছরি-বৌদি। অথচ অমরেশ মিছরি- বৌদিকে নিয়ে কী লোফালুফিই না করেছে একদিন । দোল খাইয়ে, ঘোড়ায় চড়িয়ে মোট। করবার জন্যে অমরেশের বকুনির আর অন্ত ছিল না। কিন্তু এ পরিবর্তন হল কী করে! মিছরি-বৌদি ঘামতে ঘামতে এল । হাতে একগাদ। জিনিস-পত্তোর । আবার রিকৃশীয় উঠে আমার পাঁশে বসে রিকৃশাওয়ালাকে বললে, চল্‌, জল্দি জল্দি চল্‌-_ আমার দিকে চেয়ে মিছরি-বৌদি বললে, “মোটা হওয়ার অনেক বিপদ, ঠাকুরপো-_দেখছেন কী ঘামছি ! অথচ আগে কত ওষুধ খেয়েছি, কত বকুনি কন্তাপক্ষ তি খেয়েছি ওর কাছে এই জন্যে । বলতেন, তোমাকে নিয়ে সমাজে বেরোতে আমার লজ্জা করে। তা! বলুন তে। ঠাকুরপে॥ এখন কি আমাকে ভালো দেখায় ? বললাম, “তা দেখায় বৈকি !, “আর আগে? বললাম, আগেও ভালে দেখাত, তবে এখন আরো ভালো দেখায় ।- তা অমরেশ কী বলে? মিছরি-বৌদি বললে, 'উনি আর কী বলবেন? আমার দিকে চেয়ে দেখলে তো! কেবল নিজের স্বাস্থ্য নিয়েই ব্যন্ত। এই দেখুন না বিস্কুট লজেন্স নিয়ে যাচ্ছি ওর জন্যে 1, 'অমরেশ লজেন্স খাবে নাকি বুড়ে। বয়েসে £ মিছরি-বৌদি বললে, “কেবল খাবার জন্যে যখন বায়না ধরেন তখন ছুটে! লজেন্স দিয়ে বলি চোষো, নইলে বড় বিরক্ত করেন কিনা! আর আমি তো সারাদিন ইস্কুলে, সকালবেলা খাইয়ে দাইয়ে রেখে ইস্কুলে চলে আসি, সন্ধ্যেবেল। গিয়ে দেখি ঘুমিয়ে পড়েছেন |, কেমন যেন অবাক্‌ লাগলো । কিছুই বুঝতে পারলাম না । বললাম, “আজকাল অমরেশ সন্ধ্যেবেলায় ঘুমোয় নাকি? মিছরি-বৌদি বললে, “সকাল-সন্ধ্যে-বিকেল সব সময়েই ঘুমোচ্ছেন, আমি তে। তাই বলি--অত ঘুম ভালে! নয়, সারাদিন ঘুমোলে ক্ষিদে তে! পাবেই, তাই বিছানার পাশে এই বিস্কুট, লজেন্স, আপেল, কমলালেবু ছাড়িয়ে কেটে রেখে আমি । আমারও তো চাকরি ঠাকুরপো, বেশি কামাই করলে আমাকেই বা চাকরিতে রাখবে কেন? আজকাল তো পয়সা ফেললে লোকের অভাব হয় না-চাঁকরির বাজার তো দেখছি ।' আরো আশ্চর্য লাগলে ৷ বললাম, “সারাদিনই ঘুমোয় অমরেশ তো, আপিস যায় কখন ?* মিছরি-বৌদি বললে, “উনি তে! রিটায়ার করেছেন ! ১০৭ কন্তাপক্ষ রিটায়ার করেছে অমরেশ ! এই বয়েসেই রিটায়ার করলো ! চল্লিশও হয়নি যে। মিছরি-বৌদি বললে, “না, বুঝলুম না-হয় যে রিটায়ার করলে পুরুষ- মানুষের খারাপ লাগেই, বিশেষ করে ওর মতন ছটফটে মানুষের পক্ষে। কিন্তু তা বলে ঘুমোনো। কেন পড়ে-পড়ে ? বই পড়লেও তো! হয়। ভালে! ভালে। বই লাইব্রেরী থেকে আনতো! পারি, বললে উনি বলেন, পড়তে আর ভালো লাগে না । তা আমি বলি, বই পড়তে ভালো না লাগে ছবি আঁকো, ছবি আঁকা শেখো- আমি তুলি, রঙ, কাগজ কিনে দিচ্ছি--ছবি আঁকতে কী আর হাঁতী-ঘোড়। দরকার হয়, সময় কাটানে নিয়ে তো কথা । ভালে ছবি হতে হবে তার কী মানে আছে, তাতে অন্তত মনটা প্রফুল্ল থাকবে-মনটাই তো সব। মন খারাপ হলেই স্বাস্থ্য খারাপ--তা আমার কথ! তে। কোনদিনই শুনলেন নী; জিগ্যেস করলাম, “অমরেশ একসারসাইজ. করে আজকাল ? মিছরি-বৌদি বললে, সে-সব এখন চুলোয় গেছে, ঠাকুরপো। অন্য কিছু না করুন, ডাম্বেল ছু'টোও তো ভীজতে পারেন-_-সে-সব মরচে পড়ছে! এবার ভাবছি বেচে দেব সব এতোয়ারী বাজারে পুরনো লোহার দোকানে। কত টাকার জিনিস বলুন তো, ঠাকুরপো । শুধু শুধু ফেলে রেখে লাভ কী-- জিগ্যেস করলাম, “আর খাওয়া! ! খাওয়। সেই রকম আছে ? তিরিশ- খানা রুটি, আর...ঃ মিছরি-বৌদি হাসলো, বললে, আছে, তবে সে-রকম আর নেই, সে-রকম তে! আর পরিশ্রম হচ্ছে না। আগে ফ্যাক্টুরিতে পরিশ্রম ছিল খুব, ফ্যাক্টুরির ইলেকট্রিক করাতট। চালাতেন-_সমস্ত প্ল্যাণ্টটারই তে। ইনচার্জ ছিলেন । ত৷ বাবা মারা না গেলে ওঁকে আরো উন্নতি করে দিয়ে যেতেন-_বাবাঁও হঠাৎ মারা গেলেন আর ওরও...কিস্তু বাবাও বলেছিলেন ওকে, ক্যাক্টররির কাজে অত ছটফটে স্বভাব হওয়া ভালে। নয়, বেশ ধীর স্থির হতে হবে, শুধু গায়ের জোরের কাজ নয়, কন্তাপক্ষ ূ ১০৮ চড়াই উতরাই রাস্তা । হঠাৎ যেন মনে হল, এ তো অন্যদিকে চলেছি! জিগ্যেস করলাম, “এ কোন্‌ দিকে চলেছেন, বৌদি ? “কেন ঠাকুরপো, ঠিক দিকেই তো চলেছি। আমরা তো! ফ্যাক্টরির বালে! ছেড়ে দিয়েছি বহুকাল, এখন তো। এতো য়ারী বাজারের কাছে বাড়িভাড়া নিয়েছি একটা, আমার ইঞ্ক্ুলটা কাছে পড়ে, আর তা ছাড়া ওদিকে ভাড়াও একটু সস্তা-উনি পেনসন পান, আর...আর আমার ইস্কূলের চাকরি--সব দিক বুঝে শুনে তো চলতে হবে? একটা চাকর শুধু রেখেছি ওঁকে দেখবার জন্যে, আর রান্নাবান্না আমি নিজের হাতেই করে নিই-_ছু'টো। লোকের তো রান্না। সেই চাকরই মাইনে নেয় কুড়ি টাক করে।, “এখানে চাকরের তো৷ অনেক মাইনে ? মিছরি-বৌদি বললে, “তা অনেক মাইনে কি সাধ করে দিই ঠাকুরপো, সবই তো। করতে হয় তাকে-_বাজার করা, হাঁট করা, জল তোলা। ওর দ্বার? তো একট কুটে। পর্যন্ত নেড়ে উপকার হবার নয় ? বললাম, “একেবারে শেফ বসে বসে খাচ্ছে নাকি ? বসে হলে তো বাঁচতুম ঠাকুরপো, শুধু শুয়ে। জানালা খোল। থাকলে পর্ধন্ত বলেন,__ওটা বন্ধ করে দাও, চোখে আলে। লাগছে । তা বলুন তো ঠাকুরপো, শরীরে একটু আলো হাওয়। লাগানো ভালো না? মনটা না হলে ভালে থাকবে কেন? কী জানি কেমন যেন অবাক লাগছিল । অমরেশ শেষকালে এমন হয়ে গেল! অথচ কতদিন কতভাবে নিজেই তো ও-সব উপদেশ দিয়েছে আমাদের । বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে বুঝি ওমনিই হয় । মিছরি-বৌদি বললে, “এই তো আজ ছুটির দিন, আমাদের ইস্কুলের সেক্রেটারির ফ্যামিলি বন্বে যাচ্ছিল, তাই স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিতে গিয়েছিলাম, গিয়ে এখন চান করাবে। ওকে- রান্না চড়াবো--কত কাজ পড়ে আছে।'; ১০৯ কন্ঠাপক্ষ বললাম, “তাহলে অমরেশের বাত হয়েছে বুঝি, বৌদি? খুব যাঁরা একসারসাইজ করে তাদের কিন্তু এরকম বাত হয় শুনেছি ।, মিছরি-বৌদ্ি বললেন, “হয়নি । কিন্তু বাত হতে আর দ্রেরিও নেই ঠাকুরপো, এই আপনাঁকে বলে রাখলুম 1, বলে রিকৃশাওয়ালাকে বললে, “এই-_রাখ২ রাখ _ রিকৃশা থামতেই নামলাম আমরা। সামনে চেয়ে দেখলাম, পুরনে। ইটের গাথুনি-করা একট বাঁড়ি। কয়েকট। ছাগলছানাঃ ছুটে। মুরগি চরে বেড়াচ্ছে সামনে । একটা মোটরের পুরনো মার্ডগার্ড মরচে ধরে ঝাঝরা হয়ে পড়ে আছে বাঁড়ির পাঁশেই। মিছরি-বৌদিকে কেমন যেন বেখাগ্সা লাঁগলে। এই পরিবেশের মধ্যে । সেদিন সেই অমরেশের বাঙলোতে যেমন সেই মিছরি-বৌদিকে মানায়নি, আজকের মিছরি-বৌদিকেও যেন এই এতোয়াঁরী বাজারের ভাড়াটে বাড়িতে মানালো ন। একেবারে ! জিনিসপত্তরগুলো। হাতে করে নিয়ে মিছরি-বৌদি বললে, "আসুন ঠাকুরপো, এই আমাদের বাঁড়ি।? সেখানে যে ঘরে গিয়ে বসলাম, সেটাও যেন কেমন নোংরা-নোংর' মনে হল। বললাম, 'অমরেশ কোথায় ? মিছরি-বৌদি বললে, “শুয়ে আছেন নিশ্চয়ই । দেখি__ বলে পরদা সরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। আমি একল৷ চুপচাপ বসে রইলাম । দেওয়ালে সেইসব ছবিগুলো ঝুলছে-_স্তাণ্ডো, এ্যাপোলো, হারকিউলিস। মিছরি-বৌদি হঠাৎ দরজার পরদা সরিয়ে বললে, “যা বলেছি তাই--এই দেখুন ঠাকুরপো- আপনার বন্ধুকে দেখে যান ।' গেলাম । দেখলাম খাটের ওপর চাদর ঢাক দিয়ে শুয়ে আছে অমরেশ। কিন্ত যাকে দেখলাম, তাকে অমরেশ বললে একটু ভূল হয়। সে অমরেশের প্রেতাআ। যেন। কন্ঠাপক্ষ ১১৪ মিছরি-বৌদি বললে, “দেখলেন তো ঠাকুরপো, আমি যা বলেছিলুম । এই এত বেল! পর্যন্ত ঘুমোলে শরীর থাকে, না, মন ভালে। থাকে ? বলে হঠাৎ ডাকতে লাগলো, শুনছে ওগো শুনছো, কে এসেছে দেখো ।? একটু ডাকতেই ঘুম-ভেডে গেল অমরেশের | ভাবলাম__এখনি আমাকে দেখে, হযুত উঠে, পিঠে একটা কিল বসিয়ে দেবে আনন্দের চোটে | কিন্ত কিছুই করলে না অমরেশ । শুধু বললে, “কিরে, তুই এসেছিস্‌ ? বললাম, “শুয়ে আছিম্‌ কেন? বাইরে আয় না।, অমরেশ বললে, বাইরে 1...বাইরে নয়, তুই বরং এখানে বোস্-_ওই চেয়ারটা টেনে নে।? বললাম, "ঘরের ভেতরে কেন ? বাইরে ওই ঘরে চল্‌ ন11; অমরেশ বললে, “বাইরে যেতে পারি না কেন ?' (পা যে কাটা, ছুটো পা-ই.*'জানিস না তুই ? পা-কাট। ! কেমন যেন হতবাক্‌ হয়ে গেছি। অমরেশ বললে, “কেন, খবরের কাগজে তো বেরিয়েছিল, ইলেকট্রিক স' মেসিনে প1 ঢুকে গিয়েছিল-_-এই গ্যাখ ।, বলবে। কি, সেদিন অমরেশের বাড়ি গিয়ে দিনট! যে কী করে কাটিয়েছি তা আমিই জানি। আমি তখন আকাশ-পাতাল ভাবছি। কিন্ত খানিক পরেই অবশ্ঠ মিছরি-বৌদি আমায় ছুর্ভোগ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল সেদিন। ঘরে ঢুকে বললে, 'আপনি একটু ও-ঘরে গিয়ে বসুন তো ঠাকুরপো-_ চান করিয়ে দিই ওঁকে-_বেল! একেবারে পড়ে এল । আপনার কিন্ত খেতে একটু দেরি হয়ে যাবে ভাই, কিছু মনে করবেন ন। যেন ।। চেয়ে দেখি মিছরি-বৌদির হাতে বেড-প্যান। তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে চলে এসেছিলাম মনে আছে। কিন্ত আজ এতদিন পরে একট। সত্যিকথ। বলবো । সেদিন অমরেশের কাট। পা-ছুটোর চেহারা দেখে মুখ দিয়ে যে একটা “আহা” শব্বও বেরোয়নি, ১১১ কন্তাপক্ষ সে শুধু মিছরি-বৌদির কথা! ভেবেই । আমার যেন কেমন মনে হয়েছিল মিছরি-বৌদি হয়ত অমরেশের ওপর তার বহুদিনের পোষ রাগের প্রতিশোধ নিচ্ছে! আর, তা ছাড়া অমরেশের পা না কাটলে কি মিছরি-বৌদির স্বাস্থ্যই ফিরতো, না, মিছরি-বৌদিই এমন সুন্দরী হত ! এ-গল্পট। শুনেও সোনাদি বলেছিল, “তুই আমায় কথা দে, দশ বছর তোর লেখা আর ছাপাৰি না কোথাও |, এখন বুঝতে পারি, সোনাদি কতখানি উদারতা নিয়ে আমার গল্পগুলো শুনতো। কিন্তু মতামতগুলে! ছিল নিরপেক্ষ । আমাকে বার বার কেবল লেখ। ছাপতে বারণ করেছে । বলেছে, 'লেখা ছাপতে এত আগ্রহ কেন তোর? লেখ ছাঁপা' হলেই কি মহা-লেখক হয়ে যাবি ? সব দিক থেকে যখন হতাশ হয়ে আর কোথাও যাবার মত জায়গা থাকতো না আমার, তখন যেতাম সোনাদির বাড়ি। কিন্তু না-গেলেও কোনদিন কোনো অন্থুযোগ শুনিনি সোনাদির কাছে। এ শুধু আমার ব্যাপারেই নয়। ছেলেমেয়েদের অস্থুখেও কোনে উদ্বেগ দেখিনি কখনও। মনে হোত সোনাদি যেন সারা পৃথিবীতে একলা । দাশসাহেব, স্বামীনাথ- বাবু কেউ-ই তাকে সঙ্গ দিয়ে সুখী করতে পারেন নি। সোনাদিকে স্ত্রী পেয়েও স্বামীনাথবাবু যেন তাকে বেশি কাছে পাননি! দাশসাহেবের বাড়িতে থাকলেও যেন দূরে চলে যায়নি সোনাদি |! নিজের চারদিকে এক হুর্ভেছ্য রহস্য-জাল জড়িয়ে রাখে অনেকে । সোনাদির তা-ও ছিল না। সহজ-সরল স্বাভাবিক ব্যবহার সোনাদির। তবু সোনাদিকে কাছে পাবার গৌরব কারো কপালেই যেন নেই। সোনাদি যেন কাছে থেকেও সুদূর, আবার দূরে গেলেও যেন দূরে যায় না। সোনাদি কারো কোনও কাজে কোনদিন আপত্তি করেনি, তবু কোনে! কাজ করতে গেলে যেন সোনাদিকে না জিগ্যেস করলেও চলবে না ! জববলপুরে সোনার্দির যে-আচরণ অনেকের চোখে অস্বাভাবিক মনে কন্যাপক্ষ ১১২ হয়েছে, দাশসাহেবের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসার পর তা যেন তাদের চোখে অসঙ্গত মনে হল। কেউ আর সোনাদিকে বুঝতে পারলো না । কিন্তু বুঝেছিলেন বোধহয় স্বামীনাথবাবু। তিনি সোনাঁদিকে অল্পদিনেই চিনে নিয়েছিলেম তিনি জানতেন এবং বিশ্বাসও করতেন, বাইরের সেবার দ্বারা যে পুজে!৷ তার চেয়ে হৃদয়ের প্রেমের দ্বারা যে ভোগ তা বড় জিনিস। তিনি বুঝেছিলেন__ভেতরট' যেখানে সম্পূর্ণ, বাইরেট। সেখানে বাহুল্য। সংসারে এক-একজন মানুষ থাকে যার! নিজেদের বিকীর্ণ না করে বাঁচতে পারে না। অন্তরের মধ্যে যেখানে সমাপ্তি, সেইখানেই পূর্ণতা বলে তারা বিশ্বাস করে না। অথচ জীবনে সমাপ্ডিট। যেমন সত্যি, ব্যাপ্তিটাও তাঁর চেয়ে কম সত্যি নয়। ভাব বদি সত্যি হয়, তো প্রকাশ কম সত্যি নয় তা বলে। পরিণতি যদি সত্যি বলে মানি, পরিপূর্ণ তাকে অস্বীকার করতে পারিনে কোনও কারণেই। তা একদিন দাশসাহেব জববলপুরের চাকরি থেকে ব্দলি হয়ে চলে এলেন কলকাতায় । রতি আর শিশু বায়না ধরলে “তুমি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে না, মা? দাশসাহেব বললেন, তুমি আদর দিয়েই ওদের বাড়িয়ে দিয়েছ !, শেবে যাবার দিন ঘনিয়ে এল । জিনিসপত্তোর বাঁধা-ছাঁদা হল । দাঁশ- সাহেব বললেন, “কলকাতায় গিয়ে ওদের নিয়ে একল। মুশকিলে পড়বো সোনাদি বললে, তুমি তোমার অফিসে যেয়ো, আমি দেখবে ওদের |” তুমি ? স্বামীনাথবাবুকে গিয়ে সেদিন সোনাঁদি বললে, “পরশু দাশসাহেবের সঙ্গে কলকাতায় যাচ্ছি, তোমার আপত্তি নেই তো? স্বামীনাথবাবু বললেন, 'হাঁওয়। বদলালে তোমারও শরীরট? ভালো হবে।, হাওয়। বদলাতে তো যাচ্ছি না|? “তবু কলকাতায় তো অনেকদিন যাঁওনি, দেখাশোনা হবে অনেক লোকের সঙ্গে ।' ১১৩ কন্তাঁপক্ষ সোনাদি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল । তারপর জিগ্যেস করলে, “কিন্ত কেন আমি কলকাতায় যাচ্ছি, তা তো জিগ্যেস করলে না ? স্বামীনাথবাবু বললেন, “তুমি ভালো বুঝেছ তাই যাচ্ছ, তুমি তো৷ অবুঝ নও ।” “কিন্ত পুটুকে একল। দেখতে পারবে তো তুমি ? 'পুঁটুর জন্যে তুমি কিছু ভেবো নাঁ।, 'আসছে মাসের পনরোই পুটুর জন্মদিন, নতুন জাম1-কাঁপড কিনে দিয়ে, আর কানের একজোড়া ছুলও ওকে দিয়ো-_এই চুড়িটা ভেঙে গড়িয়ে দিয়ো |, স্বামীনাথবাবু বললেন, “টাক তো রয়েছে, চুড়িট। তুমি রাখো |, তা হোক, তবু নাও। স্বামীনাথবাবু প্রতিবাদ কখনো করেননি । হাত বাড়িয়ে নিলেন। যাঁবার দিন সোনাঁদি বললে, “জিগ্যেস করলে না তো, কবে আসবো ? তুমি তো৷ আমার চেয়ে ভালো বোঝো । যতদিন খুশি থেকো, তারপর রতি-শিশুকে বুঝিয়ে রেখে একদিন এসো ॥ ননদদের তখন বিয়ে হয়ে গেছে । যার-যার শশুরবাড়িতে তারা ! বিশ্বেশ্বরবাবুও মারা গেছেন আজমীরে। আত্মীয়-পরিজন যাঁরা রাঁজস্থানে ছড়িয়ে ছিল, তারাও আর যোগাযোগ রাখেনি । পরিবারের বৃহৎ শাখা- প্রশাখা। কে কার খবর রাখে? সেই সময়ে দাশসাহেব ছেলেমেয়ে নিয়ে জব্বলপুরের সংসার তুলে নিয়ে কলকাতায় এলেন। র স্টেশনে স্বামীনাথবাবু তুলে দিতে এসেছিলেন পুটুকে নিয়ে । সোনাদি বললে, 'আধসের করে দুধ নিয়ো রোজ নিজের জন্যে |; “আমার জন্যে ভেবো না বেশি, নিজের শরীরের দিকে নজর রাখবে ।; সোনা্দি বললে, 'পুটুর ইস্কুলে খাবার পাঠাতে ভূলে না৷ যেন।, স্বামীনাথবাবু বললেন, “গিয়ে চিঠি দিয়ো । ৮ কন্তাপক্ষ ৪ ট্রেন ছেড়ে চলে গেল। পটু জিগ্যেস করলে, “মা কোথায় গেল বাবা ? স্বামীনাথবাবু বললেন, “মা তো৷ কোথাও যায়নি মা, কাদতে নেই, ছি --আমি কি কীদছি ?? কলকাতায় এসে দাশসাহেব নতুন বাড়িতে বাসা করলেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজে একটা ব্যাঙ্ক করলেন। ব্যাঙ্কের নামট। আপনারাও জানেন। নামটা আমার মুখে না বলাই ভালো । রতি আর শিশু নতুন ইস্কুলে ভর্তি হল। সেখানেই ওই অসুখট। সুরু হল সোনাদির। সেই অদ্ভুত অসুখ। কিছু কাজ করতে পারবে না । ডাক্তারে বললে,-_ শুধু শুয়ে বসে থাকতে হবে। অথচ খাওয়া-দাওয়ার কোনো বাছ-বিচার নেই। ডাক্তার আরো! বললে, “এ-ও একরকম টি-বি।, সোনাদি বললে, 'রতি-শিশুকে তুমি দূরে বোঁভিং ইন্জুলে পাঠিয়ে দাও 7 দাশসাহেব তাই-ই করলেন। “আর তুমি ? 'আমার কথা বলছে। ? সোনাদি বললে, আমার কাছে তুমি এসে না, রোগট। ভালো নয়।, দাশসাহেব হাসলেন । বললেন, “তামার কাছে কেউ আসতে পারে, এমন কথা কোনো অ.হাম্মকেও বলবে না, সোন। |, তারপর খানিক থেমে বললেন, 'জববলপুরে স্বামীনাথবাবুকে একট! খবর দিই, কী বলো-_হয়ত ভাববেন খুব ।, সোনাদি বললে, এবরট। পরে দিলেই চলবে, তাড়াতাড়ি কী? বলে হাসলে। সোনাদি। ননদরা! এসে জিগ্যেস করে, “বৌদি কোথায় দাদা ? সব শুনে তারাও অবাক্‌ হয়ে যায়। বলে, “তুমি একটু কড়া হতে পারো! না দাদ।? ৯১৫ কন্তাপক্ষ স্বামীনাথবাবু হাসেন। 'তুমি হাসছে ? তবু স্বামীনাথবাবু হাসেন । বলেন, “তোরা শুধু বাইরেটাই দেখিস, লোকে কী বলবে এইটেই ভাবস; আমি তো কিছু তফাত দেখতে পাই না, আমার মনে হয় ও এখানেই আছে__১ ননদ বলে, “তুমি কি পাথর দাদ। ?..*সত্যি বলো তো কিছু ঝগড়া হয়েছিল বুঝি?” 'ঝগড়। করবার মতো। লোকই বটে রে সে, চোখের সামনে দেখলেও আমি তা বিশ্বাস করবে৷ না।, “তোমার কথা৷ ছেড়েই দিলাম, তুমি ন। হয় দেবতা, কিন্তু তার ওই নিজের পেটের একফৌটা মেয়েটা 1 “তা পুটুর তো৷ কোনো অন্ুবিধে হচ্ছে না_ অসুবিধে হচ্ছে নাকি? 'জন্ম দিয়েই যে কত ছেলের ম। মারা যাঁয়, তাতে কি অন্ুবিধে হয় তাদের? কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে যে মুখ দেখাতে পারবো না দাদা !? “তোর তে। বড় কষ্ট.হবে তা হলে ? “কষ্ট! তুমি বলছে! কি দাদা, আমার যে আত্মঘাতী হতে ইচ্ছে করছে।' তুই ওঁদের বলিস, আমার অনুমতি নিয়েই সে গেছে” “বৌদিকে তো। জানি, তোমার অনুমতি নিতে তার বয়ে গেছে ।, নারে, অনুমতি নিয়েছে, আর মুখ ফুটে অনুমতি চাওয়াটাকেই কি তোরা বড় ভাবিস-_-আর তা ছাড়া এই একট? জীবনে আমাদের কতবার জন্ম নিতে হয়, জানিস তুই? মহাভারতে পাগুবদের জীবনে অজ্ঞাতবাসের পাল এসেছিল একবার, সেটা কি ভাবিস একেবারে অর্থহীন? তা তে! নয়, আমি মনে করি সেট! তাদের আর এক নবতর জন্মের উদ্ঠোগপর্ব_- তা এসব কথ! তোর শ্বশুর-শাশুড়ীরা যদি না বোঝেন তো বলিস তাদের কন্তাপক্ষ ১১৬ যে, যাকে অনুমতি দিতে পারলে কৃতার্থ হয় লোক, তার অনুমতি চাওয়া- না-চাওয়া তুচ্ছ-_ “যদি কখনও ফিরে আসে বৌদি তে। বাড়িতে তাকে ঢুকতে দিয়ো না দাদা, আমাদের বংশের মুখ পুডিয়েছে সে ।, “ও কথা বলিসনি, ওতে আমার কষ্ট হয় রে কষ্ট তোমার ছাই হয়, দাদ “ন। রে, তাকে ছাড়া আমি একদিনও থাকতে পারি না, সত্যি বলছি । তবে এখন আছে কেমন করে ? সে তো আমার কাছেই আছে সব সময়, মনে হয় যেন পাঁশের ঘরেই আছে, ডাকলে সাড়া দেবে, যেমন তার বই নিয়ে পড়াশোনা করতো! তেমনি করছে! জীব অন্ন, না বিভূ” এই নিয়ে তাঁর সমস্যার আর শেষ নেই। তোর বৌদির ওপর তোরা অবিচার করিস নে বিকেলবেলা! ননদ বললে, পুটুকে আবার ছুধ পাঠাচ্ছ ইস্কুল, দাদ ? “কিন্তু সে যে দুধ পাঠাতে লিখেছে সেখান থেকে ॥ “কাল তো ছুধ খায়নি ও, ফেলে দিয়েছে যে সবটা 1, তা হলে আবার চিঠি লিখে পাঠাই ।? “এ-ও তাকে জিগ্যেস করতে হবে, দাদা! তোমার কি নিজের কিচ্ছু করবার ক্ষমতা নেই ? “সে-ই যে এ-সংসারের গিন্নী রে, তাকে না জিগ্যেস করে কি কিছু করতে পারি ? “সংসার জালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে যে চলে গেছে, তার তো এ সংসারের জন্যে ভারি মাথাব্যথ। !, দাশসাহেব অফিসে যান। গিয়ে একবার ল ফোন করেন, “কেমন আছে, সোনা ? সোনাদি বলে, “তোমার রাড-৫্রসারট। যদি সারে তে। কী বলেছি! ১১৭ কন্তাপক্ষ অভিলাষকে ডেকে বলে দিলে সোনাদি, “তোমার সাহেবকে খেতে দেবার আগে আমাকে জিগ্যেস করে দিয়ো এবার থেকে ॥ সকালবেল। সোনাদি বলে, কাল অনেক রাত্রে তোমার ঘরে আলো বলছিল কেন? ঘুম আসছিল না যে।, “কাল থেকে যেন আলো ন। দেখতে পাই আর ।, তা এই ঠিক এমনি সময়ে আমি এসে পৌছুলাম সোনাদির জীবনে । জীবনে অনেক রকম চরিত্রের সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু অদ্ভূত লাগলো! কোথাও কোনো বিরোধ নেই! রাত ন'ট। বাজলেই সোনাদি দাশ সাহেবকে বলে, যাও, নণ্টা বাজলো, এবার শোওগে যাও, গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে আলো নিবিয়ে দেবে ।, দাশসাহেব হয়ত মৃছু প্রতিবাদ করেন, “ঘুম এখন আসবে না আমার ।, “না আন্ুক, শুয়ে থাকোগে ॥ নিঃশবে দাশসাহেব চলে যেতেন। যেন ছোট শিশুটি দাশসাহেব-_ ঘুম পাড়িয়ে তবে সোনাদির স্বস্তি। এক-একবার মনে হত সোনাদি বুঝি আমাদের সকলের মা, আর আমরা সবাই ছেলে-মেয়ে । ওই স্বামীনাথ- বাবু, দাশসাহেব, আমি, রতি, শিশু, পুটু__সবাই । এক-একদিন এরই ফাকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মাইলের পর মাইল দূরে চেতলা থেকে আপার সারকুলার রোড । সেখানে 'প্রবাসী' অফিস। সাইকেলট। উঠোনে চাঁৰি দিয়ে বেঁধে ছুরু-ছুরু বুকে সিড়ি দিয়ে দোতলায় গিয়ে উঠি। সোনাদি যতই বলুক, 'প্রবাসী'তে লেখা না ছাপ৷ হলে স্বস্তি পাই না । পপ্রবাসী”তে লেখা ছাপা ন। হলে জীবনই বৃথা । সম্ভ দেখে এসেছি আমার গল্প বেরিয়েছে “ছায়ার মায়া” । ব্রজেনবাবু থাকতেন ডানদিকের ঘরে সামনের চেয়ারে । বড় গম্ভীর মানুষ । দেখলে ভয় হত। বললেন, “কী চাই ? বললাম, “একটা গল্প ছাঁপ। হয়েছে এ-মাসে | 'কার গল্প? দাদার ?' কন্যাপক্ষ ১১৮ ছোট ছেলে দেখে বোধহয় বিশ্বাস হয়নি | বললাম, “আমার-- যেন না জেনেশুনে মহ! অপরাধ হয়ে গেছে তার ! অন্তত এত কম বয়েস আগে জানলে যেন লেখ! ছাঁপতেন না। অতি রূঢ় ব্যবহার । কোনও আশা বা উৎসাহ পেতাম ন! সে-দৃষ্টিতে। অথচ কত আশ নিয়ে গিয়ে- ছিলাম। একটার পর একটা গল্প ছাপিয়েছেন, কিন্ত দৃষ্টির রূঢ়তা তবু একতিল কমেনি । তারপর আবার সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে যেতাম “ভারতবর্ষ অফিসে । গায়ের জাম! "খুলে দিয়ে জলধর সেন মশাই ইজি- চেয়ারে শুয়ে আছেন। কানে খাটো ছিলেন। জোরে জোরে সমস্ত অফিস-সুদ্ধ লোককে শুনিয়ে নিজের নিজের নিবেদন জানাতে হয়। বলেন, “আমার গল্পট। তুমি 'প্রবাঁসী'তে ছাপিয়েছ নাকি ? বললাম, “না, ওট? অন্য গল্প, যাবে, যাবে, আসছে মাসে যাবে।? বুকে ভরস! নিয়ে সেখান থেকে যেতাম “বিচিত্রা” অফিসে । উপেনবাবু কিন্ত বসতে বলতেন । উপেন্দ্রনাথ গঙ্গেপাধাঁয়। গল্প করতেন । উৎসাহ দিতেন । মর্যাদা দিতেন। আবার লেখ দিতে বলতেন । সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । কিন্তু তারপর সারারাত ধরে আমার লেখা চলতে আবাঁর। এক-একদিন ভোর হয়ে যেত। তখন আবার লেখাটা নিয়ে কোনো বন্ধুকে গিয়ে পড়িয়ে শুনিয়ে এসেছি । কিন্তু সোনাদিকে পড়াতে তবু ভয় করতো । কত লোভ হত। মনে হত এবার হয়ত সোনাদি ভালো বলবে । এবার হয়ত ছাপাঁতে অনুমতি দেবে । কিন্ত সামলে নিতাম নিজেকে । মনে হত--সোঁনাদির ভালো লাগবার মতো লেখা কবে লিখতে পারবো ! কবে সোনাদির পছন্দমতো হোঁমারের “ইলিয়ড» “অডিসি' কিস্ব! কাদশ্বরীর মতো কাব্য কিন্বা। বালীকি বেদব্যাসের মতো রামায়ণ", “মহাভারত” লিখতে পারবো ! কবে তেমন লেখা আমার হাতে বেরোবে । প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বিচিত্রায় তখন মাসের পর মাস গল্প বেরিয়েছে । ১১৯ কন্াপক্ষ আমার এক বন্ধু একদিন বললে, “দেশ কাগজে একটা লেখো, ও-কাগজট। ভালে হচ্ছে আজকাল-_” | মনে আছে “আমীর ও উর্বশী” গল্পট। নিয়ে গিয়ে দিয়ে এলাম একদিন। কাউকেই চিনি না। বন্ধু পরের দিন জিগ্যেস করলে, কী নিয়ে লেখা ? মুখে বললাম সব গল্পট।। বন্ধু শুনে বললে, “ও-গন্প ওখানে ছাপবে না, ও-কাগজের পক্ষে একটু কড়া হয়েছে ।” কীজানি কেন--আমাঁরও মনে হল হয়ত তাই। সেই রাত্রে আর একট। গল্প লিখে পরদিন নিয়ে গেলাম হাতে করে। শ্রীযুক্ত সাগরময় ঘোষ বসেছিলেন। গিয়ে নিজের নাঁম বললাম। আরে বললাম, পুজো-সংখ্যার জন্যে একট গল্প দিয়ে গিয়েছিলাম, আমার এক বন্ধু বললে, ওটা নাকি আপনাদের কাগজে ছাপার মতে নয়__তা আমি আর একট লেখা নিয়ে এসেছি শুনে তিনি খুঁজে খু'জে বার করলেন “আমীর ও উর্বশীর" পাগুলিপিট!। বললেন, “আপনি বসুন, আমি পড়ে দেখছি গল্পট11/ তারপর চুপ করে অবীর আগ্রহ নিযে আমি সেইখানে বসে রইলাম, আর তিনি পড়তে লাগলেন। এক-একটা মিনিট যেন আর কাটতে চায় না! মনে হয় বিচারকের সামনে যেন নিজের দণ্ড শোনবাঁর প্রতীক্ষায় কাঠগড়ায় দাড়িয়ে আছি। এক সনয়ে তিনি মুখ তুলে বললেন, গল্প খুব ভালে হয়েছে, এটা যাবে, আমি ছাপবে। এ-গল্প ।, আমি অবাক্‌ হয়ে গেলাম । বললাম, “আপনি ছাঁপাবেন, ওতে যে-**, “যা-ই থাক, আমি ছাপবে|।) / তার মুখ দেখে মনে হল তিনি যেন মরিয় হয়ে বলছেন, “আমি ছাপবো, কিছু হবে না।? কিন্ত তবু সোনাদিকে সে-গল্প পড়াতেও আমার সাহস হয়নি। ছাঁপলেই যেন অপরিণত বয়েসের লজ্জা চিরস্থায়ী হয়ে রইল। এপিক্‌ কন্ঠাপক্ষ র ১২৪ ছাড়া সোনাদির আর কিছুই ভালো লাগে না। বাজারচল্তি লেখ সোনাদির কাছে সব অপাঠ্য । ব্রজেনবাবু, জলধরবাবু, উপেনবাবুরও যে- লেখা ভালো লেগেছে, সোনাদির যেন তা ভালো লাগবার কথা নয় ! ভাগ্যিস সোনাদি ও-সব পত্রিক! কিছুই।পড়ে না, নইলে আমার হয়ত ও- বাড়িতে যাওয়াই বন্ধ হত ! সেদিন সোনাদিকে আমার “রাঙ। মাসিমা”র গল্পটা! বলেছিলাম । রাঙা মাসিমার গল্পটা তখনও লেখা হয়নি । শুধু নোট্‌ বইতে স্বেচ করে রেখেছি । মাসিমা আর মেসোমশীই-এর সম্পর্কটাঁও আমার কাছে বড় বিচিত্র লাগতে বরাবর । ম1] বলতো, 'আহ। ! কী কপাল করেই যে এসেছিল রাঙাদি__ সতিই হিংসে করবার মতে। কপালই বটে রাঙা মাসিমার। খুব ছোটবেলায়, মনে পড়ে, বাড মাসিমার বাড়ি গেছি। তখন ভাড়াটে বাড়ি ছিল। রাঙা মাসিমা নিজের হাতে রান্না করা, ময়লা কাপড় সেদ্ধ করা, যাবতীয় কাজ করেছে । মেসোমশাই পর্যস্ত কখনও মুড়ি ছাড় আর কিছু জলখাবার পায়নি । আমাকে দেখিয়ে মেসোমশীই বলেছে, “ওকে ছুটি মুড়ি দাও ন1।, মাসিমা! বলেছে, “ওরা আর মুড়ি খায় না আমাদের মতন ।, তারপর হাতের কাজ করতে করতে বলেছে, "ওর বাবা তোমার মতো। আর অকন্মা লোক নয়--ওদের তনজনের সংসার, তবু চার সের ছুধ নেয় ওর মা, জানো ? মেসোমশীই বলেছে, 'তা মুড়ি কি খারাপ জিনিস, গা । বর্ধাবাদলের দিনে তেলমুন মেখে খেতে তো বেশ লাগে আমার ।, রাঙা! মাসিমা রেগে গিয়ে বলেছে, “তোমার মতো লোকের হাতে পড়ে মুড়ি ছাড়া যে আর কিছুই জুটবে না তা আমি জানি। যেমন ফুটো কপাল আমার !, তখনও মেসোমশাই জজ হয়নি । সামান্ত উকিল মাত্র। বউবাজারের একট গলিতে সে যে কী বাড়িতে থাকত ! একখান! মাত্র শোবার ঘর। ১৯২১ কন্তাপক্ষ তারি মধ্যে ঢালোয়া বিছানা । তিন-চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে সেই একটা ঘরের মধ্যে থাকা । আর রান্নাঘরটা গোলপাতার ছাউনি। সেই এক চিল্তে রানাঘরের মধ্যে দিনরাত কাটতো। মাসিমার । কিন্তু তবু কত যে পরিপাটি কাজ! রান্না! সারা হয়ে গেছে, খাওয়া-দাওয়া! চুকে গেছে, ছেলেমেয়ের! ইস্কুলে, মেসোমশাই কোরে-_-তখন যত রাজ্যের কাজ মাসিমার। বড়ি শুকোতে দিয়েছে রোদ্দ,রে, ক্ষার কাঁচতে বসেছে, কিংবা চাল বাছতে শুরু করেছে কুলো নিয়ে । একট] ঝি নেই, চাকর নেই ! মেসোমশাই কতবার বলেছে, “একটা বিধবা মেয়েমান্ুষ আছে, ওরা বলছিল-_মাইনে নেবে না শুধু খাবে-__রাখলেও তো পারো রাঙা মাসিমা ঝাঁজিয়ে উঠত, থামে! তুমি, তোমার মতো। অকন্ম। লোকের হাতে যখন পড়েছি, তখন জানি আমার কপালে কষ্ট আছে-_ জিগ্যেস করে! ওকে, ওদের তিনজনের সংসার, তবু ওর মাকে কখনো নিজে রাধতে হয়নি ।, মেসোমশাই বলত, “তা বলে তোমার একট। অনুখ-বিন্ুখ করলে তখন ?' মাসিমা বলতো, “অন্ুখ-বিস্রখ হলে তো। বেঁচে যাই, আমাকে আর ভূতের বেগার খাটতে হয় না তোমার সংসারে ।' মেশোমশাইকে দেখেছি ভোর বেল! উঠে নিজের হাতে নিজের জামা- কাপড় কেচে, ঘর পরিষ্কার করে বাইরের ঘরে কাজ নিয়ে বসে গেছে। তারপর চট করে এক ফাকে মকেলকে বসিয়ে রেখে বাজারও করে এনেছে । মাসিমা! দেখতে পেয়ে হৈ হৈ করে উঠেছে। 'ওকি' মাছের থলি আর আনাজের থলি একাকার করে ফেললে যে, ছিষ্টি অাশ করে ফেললে যে তুমি, অমন বাজার করবার মুখে আগুন-_ নাও, হাত ধোও ।। নিজেই জলের ঘটি নিতে যাচ্ছিল মেসোমশাই। আবার হে হৈ করে উঠেছে মাসিম!। কন্ঠাপক্ষ হিলি এ-সব কথ। যখনকার তখন আমরা খুব ছোট। তারপর বউবাজারের বাড়ি ছেড়ে মেসোমশাই কলেজ স্ীটের ওপর সদর রাস্তায় বাসা নিয়েছে । আয় বেড়েছে । ছেলে-মেয়েদের বয়েস হয়েছে । খুকুর বিয়ে হয়ে গেছে এক বড় ঘরে। খুকুর বিয়েতে মেসোমশাই জাঁকজমক করেছিল খুব। সে-বিয়েও মেসোমশাইয়ের এক মকেলের কল্যাণেই। একট পয়স। নেয়নি পাত্রপক্ষ। মকেলর!। গাদা-গাদ। জিনিসপত্তোর দিয়ে গেছে বাড়িতে বয়ে। ধন্য ধন্য করেছে সব আত্মীয়-স্বজন নতুন কুটুম দেখে। বরকর্তা বলেছে, 'জিতেনবাবু এমন সঙ্জন লোক, তার মেয়ের বিয়েতে আমর! টাকা নেব না। কেবলমাত্র মেসোমশাইকে দেখেই পাত্রী পছন্দ করেছে তারা । এমন সাধুলোকের মেয়ে ঘরে আনতে পারাও যে বহু পুণ্যের ফল। মাঁসিম কিন্ত তখনও সেই ভিড়ের মধ্যে বলেছে, "ও'র সাধ্যি কি ওই মেয়ে পার করেন, যা দেখছো মা, সব এই আমি-হেন মেয়ে ছিলাম বলে--কোনো। যুগ্যিতা নেই তো! ও'র গায়ে-হলুদ দেখে সব লোক অবাক । মেয়েকে দিতে আর কিছু বাকি রাখেনি । মাসিমাও গরদের জোড় পরে বললে, “দেখছ তো মা তোমর। ওই অকন্ম। মানুষটিকে, সেই মেয়ে-দেখার সময় থেকে এই পর্ষস্ত যা কিছু সব আমাকে করতে হচ্ছে, একট কাজ তে৷ ওঁকে দিয়ে হবার উপায় নেই ।, মেসোমশাই সামনেই দাড়িয়ে ছিল। মাসিমা বললে, 'হাসছ কি, এই তে? সবাই সাক্ষী আছে, বলুক দিকি কেউ তুমি কোন্‌ কাজটা করেছ, যে-কাজট আমি দেখবো না সব তো! পণ্ড করবে, এমন কপাল আমার মা, যে একা হাতে সব কাজ করতে হবে !; সত্যি, মাসিমাও মেসোমশাইকে দেখে এক-একবার অবাক্‌ হয়ে যেত। বলত, “আমায় একবার কাছারিতে গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করে, তুমি কেমন করে কাজ চালাও সেখানে ১২৫ কন্ঠাপক্ষ উকিল থেকে আস্তে আস্তে মেসোমশাই জজ. হল। গোলদীঘির পেছনে মস্ত বাড়ি কিনলে । নণ্ট, তখন ডাক্তারি পাশ করে রেলে চাকরি নিয়েছে। মেজ ছেলে ইঞ্জিনীয়ার হয়েছে কাশী থেকে । জম্-জমাট সংসার । তিনটে চাকর, ছু'টো ঝি। আত্ীয়-স্বজন, নাতি-নাতনি, বিধবা-সধবা গলগ্রহের কল-কোলাহলে বাড়ি পূর্ণ। তার মধ্যে সকাল খে রাত বারোট। পর্যন্ত মাসিমার কেবল ওই এক কথা ! হলে কি হবে মা, আমি যেদিকে দেখব না, সেইদ্দিকেই তোচু-প্তির যেমন হয়েছে বাঁড়ির অকন্ম। কর্তী, তেমনি সবাই, একটা মানুষ দি জের ***সবাই এ বাড়ির কর্তার ধার! পেয়েছে 1, গৃহ-প্রবেশের দিনে আত্মীয়-স্বজন সকলের নিমন্ত্রণ হয়েছে । গিয়েই মাসিমার গলা শুনতে পেলাম। বলছে, আচ্ছা, তুমি অকন্ম। মানুষ, তুমি আবার কাজের ভিড়ের মধ্যে কেন শুনি-” মেসোমশাই বুঝি নিজের গামছার খোঁজে এসেছিল :অন্দরমহলের ভেতর । মাসিমার মন্তব্য শুনে আবার যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। কোন বিরক্তি নেই, বিরাগ নেই-_সদাশিব ধীর স্থির শান্ত মানুষটি বরাবর । সামান্য অবস্থা থেকে নিজের ধৈর্য, সাহস, কর্তব্যনিষ্ঠা, একাগ্রতা দিয়ে অক্লান্ত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বিত্তশালী হয়েছে, কিন্তু কোনো হিংসা, ক্ষোভ, ছুব্যবহাঁর নেই কারো ওপর । মাসিম। বলে, “এও বলে রাখছি বাপু তোমাদের (তোমরা! এখন বড় হয়েছ, সব বুঝতে পারো!) এই আমার মতো গিন্নী পেয়েছিল বলেই তোমার মেসোমশাই এই বাঁড়ি-ঘর-দোর করতে পারলে কলকাতায় ।, পুত্রবধূদের ডেকে বলে, “এই শোন বৌমারা, এই আজ আমাকে দেখছ তোমরা এমনি, এই আমিই একদিন ছেলে মানুষ কর থেকে এই কলকাতার বাড়ি করা পর্যন্ত সব একা করেছি । আমি না থাকলে ওই ছেলেরাও মানুষ হত না মেয়েদের বিয়ে হত না। ওই অকম্ম! মান্ুষ শুধু মাসে মাসে ক'টা টাকাই এনে তুলে দিয়েছে আমার হাতে, আর তো৷ কোন যুগ্যিতা ছিল না! ও-মাম্ুষের 1, কন্ঠাপক্ষ টি যে-মান্থুবের কোন যোগ্যতা ছিল না? সে-মান্ুষ সামান্য অবস্থা থেকে এত বড় কেমন করে হল এ-প্রশ্ন কেউ কোনোদিন করেনি মাসিমাকে। দিনে দিনে বাড়ি হয়েছে, গাঁড়ি হয়েছে ; পুত্র» পৌত্র, ধন জন কিছুরই অভাব থাকেনি মাসিমার ৷ সে মুড়ি খাওয়া এখন উঠে গেছে। এখন সংসারে দৈনিক পাঁচ সাত সের দুধ খরচ হয়। নাতনিদের এক খেপে গাড়ি করে ইন্ধুলে পৌছে দিয়ে তারপর কর্তাকে কোর্টে পৌছে দেয়। মেসোমশাই গরমের ছুটিতে মাসিমাকে পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যায়। সংসার জ্ল্জ্বল্‌ করছে । চারিদিকে সাফল্য, চারিদিকে সাচ্ছল্য ! পাড়ার পাঁচ-দশজন রোজ এসে কুশল প্রগ্ন করে যায়। দেশের দশ-বিশটা ব্যাপারে মেসো- মশাই-এর ডাক পড়ে। কত অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে দাতব্য করতে হয়। সময় পাঁয় না মে:সামশাই সব জায়গায় যেতে । তবু ক'জন আমায় গীড়াপীড়ি করছিল ক'দিন ধরে, মেসোমশাইকে গিয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠঠনের সভাপতি হতে বলবার জন্যে । আমিও মাঁসি- মাকে দিয়ে বলাবো ভাবছিলাম । মাসিম। শুনে বললে, “ও-মান্ুষকে তে। চিরট1 কাল দেখে আসছি, বিয়ে হওয়া এস্তোক আমাকে জালিয়েছে। ওঁকে দিয়ে তোদের কাজের কী স্বসার হবে বলতো ? মাসিমা সত্যিই হেসে বাঁচে না। বলে, “ওঁকে সভাপতি করবে, তবেই হয়েছে-আর লোক পেলি নে রে-_ কথায় কথায় মাসিমা খোঁট। দেয়, "ওই তে! দাড়িয়ে রয়েছে ও, জিগ্যেস করো না ওকে, ওদের তো তিনজনের সংসার, এখন না-হয় ওর বউ ছেলে- মেয়ে হয়েছে, কিন্ত ওর মা কোন্‌ দিন সংসারের কোন্‌ কুটোট। নেড়েছে-_ বলুক ও । কখনও কখনও রেগে বিরক্ত হয়ে গিয়ে বলে, পারব 'না আমি এত দেখতে, তোমার সংসার তুমি দেখ, আমি পারব না। বিয়ে হয়ে বাড়িতে ঢোকা ওবদি এক দণ্ডও ফুরসৃত পেলাম না মা | কেন, কী আমার ১২৭ কন্ঠ।পঞ্ষ দায় পড়েছে । হোকৃগে সব লণ্ড-ভণ্ত, তুমি নিজে দেখতে পারো ভালো, নইলে রইলে। সব পড়ে_সব অপচো-নষ্ট হোক, আমি ফিরেও দেখবো না আর।' বলে মাসিমা নিজের শোবার ঘরে বিছানায় উঠে গিয়ে বসে। বড় বউমা লোক ভালো । মন-রাখা কথা বলতে জানে। বলে, মা, আপনি এখানে বসে থাকলে কেমন করে কী করবো) আমরা ছেলেমানুষ, কী বুঝি--আপনি সামনে বসে দেখিয়ে দিন, আমরা শিখে নি।, মাসিম। বলে, “কন, উনি কোথায়ঃ তোমার শ্বশুর-_ “তিনি তো বাইরের ঘরে ।, ডাক তাকে, ডেকে আনো, দেখুন না এসে সংসারে হুজ্জুতট1 কত !, “তা কি আর কেউ জানে না মা, সবাই জানে, আপনি তবু একবার চলুন নিচেয়।' না, তুমি যাও বউমা, আমি যাবো না, একদিন ও-মানুষ দেখুক কাজটা কী হয় সংসারে, বাই'রে বাইরে শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান তে নয়, তোমার শ্বশুরের কথ! বলছি, সারা জীবনটা আমার এমনি করে হাড়ে হাড়ে জালিয়েছে বউমা, একটা দ্রিনের তরে শান্তি পাইনি আমি, এমন অকন্মা লোকের হাতে পড়েছিলুম মা! বলতে বলতে মাসিমার চোখ সত্যিই ছলছল করে ওঠে। সাধারণতঃ মাসিমা কাক-কোকিল ডাকবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে ওঠে। সেই আুরু হয় চরকির মতো। পাক খাওয়।। কে কীখাবে, কোথায় অপচয় হচ্ছে, কার কী প্রয়োজন, সমস্ত জিনিস খু'টিয়ে খু'টিয়ে দেখবে । যেখানকার যে-জিনিস সেখানে না থাকলেই অনর্থ। রান্নাঘরের পাশে উঠোনের ঝটাট। কাত হয়ে পড়ে আছে। মাসিম! সৌরভীকে ডেকে ছু'কথা শুনিয়ে দেবে, “হা গা মেয়ে, উঠোনের ঝাটাট। যে বড় কাত হয়ে পড়ে আছে, এ কেমন ধাঁর৷ অনাছিগ্টি কাজ গ1--সবাই কি বাড়ির কর্তার ধারা পেয়েছে !, এদানি মাসিমা পুজোর সময় প্রতি বছরেই একটা-না-একটা গয়না গডাত। বউদের য। হবার তা৷ তো হয়ই। সেবার কাজের ভিড়ে স্তাকরাও কন্পক্ষ ১২৮ সময়মত জিনিসট। গড়িয়ে দিয়ে যেতে পারেনি । বার বার লোক দিয়ে তাগাদ। দিয়েও মহালয়া পেরিয়ে গেল। মাসিমা সেদিন একেবারে মেসোমশাই-এর সদরে গিয়ে হাজির ! মেসোমশাই কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মাঁসিমাকে দেখে অবাক্‌। মেসোমশাই মুখ তুলে চাইতেই মাঁসিম। বললে, “বলি, তোমাকে তো বলা বৃথা তুমি তো তোমার রাজকাজ্য নিয়েই ব্যস্ত ! “কি হল কী? “বলি, সংসারে তো। তুমিও একজন, না তুমি সংসার ছাড়া? সংসারে থাকতে গেলেই ছ"চার কথা বলতে হয় তাই বলি, নইলে আমার আর কী? যে দিন মরে যাবো, ছু'চন্ষু বু'জবে।, সেদিন তোমাকে বলতে আসবো না তুমিও নিশ্চিন্তে রাজকাজ্য করবে । তা৷ ভেবো না, তোমাকে আমি ছুষছি ; দোষ তোমরাও নয়, দৌষ আমারই পোড়া কপালের। তা নইলে এত লোক থাকতে তোমার মত অকন্মা লোকের হাতেই আমায় পড়তে হয়-- মেসোমশাই কিছু বুঝতে না পেরে বললে, “কী, হল কী বুঝতে পারছিনে তো ।; মাসিমা! বললে, হা] গা, আমার কপালেই কি যত অকম্মা জুটতে হয় ! চাকর, ঝি, বউদের কথা ন! হয় ছেড়েই দিলাম, তাঁরা ন! হয় কেউ আপনার জন নয়, কিন্তু গয়লা, স্তাকর! এদেরও কী বেছে বেছে পাঠিয়ে দাও আমার কাছে জালিয়ে খাবার জন্যে ? সেদিন গয়লা এলে তাকে সোজা শুনিয়ে দ্রিলে মাসিমা, তাকে আর দুধ দিতে হবে না বাছা, কত্তার রক্ত জল কর! পয়সা, আর তুই এমনি করে ঠকাবি! কত্তা না হয় মানুষ নয়, তা আমরাও কি চোখের মাথ। খেয়ে বসেছি ? কতদিন ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনী আমাদের সকলের সামনে মাসিম। দুঃখ করে মেসোমশাইকে বলেছে, “তোমার হাত থেকে যে কবে নিষ্কৃতি পাবো কে জানে, আর জন্মে কত পাপই করেছি 1, ১২৯ কন্ঠ |পক্ষ মাসিম। বলত, “সেই এগারো বছর বয়েসে বউ হয়ে ঢুকেছি এ-বাড়িতে আর এখন বুড়ী হয়ে গেলুম, সুখ যে কী দ্রব্য ত1 জানল্গুম না এ-জীবনে |” মা বাবাকে বলত, “পড়তে তুমি দিদির হাতে তে! বুঝতে ঠেলা, অমন দেব তার মতো স্বামী, তা-ও উঠতে-বসতে গঞ্জনা 1, বাবা বলত, «তামার দিদ্দি বুঝবে মজা একদিন--কর্তার মার! যাওয়ার পর ছেলের৷ কী করে দেখো ।; আমাদের জ্ঞান হওয়। থেকে দেখে আসছি মাসিমাকে ওই একইরকম ! আগে যখন মেসোমশাই-এর অবস্থ। খারাপ ছিল তখনও অভিযোগের অন্তু ছিল না। তারপর সংসারী মানুষের যা কিছু কাম্য, কিছু আর পেতে বাকি ছিল না মাসিমার । এ্রশ্বর্ষ, সম্পদ, আখ, স্বাচ্ছন্দ্য, সচ্ছলতা, পরিজন, দাসদাসী। তারপর ভবানীপুরের প্রাসাদতুল্য বাঁড়ি। মেসোমশাই-এর বাড়ি নয় তোরাঁজপ্রাসাদ। সমস্তই মেসোমশাই-এর নিজের চেষ্টায়, নিজের সং উপার্জনে। জীবনে কারে। ক্ষতি করেনি । কারো ওপর হিংসা, নয়। দূরের কাছের যে-কেউ আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে এসেছে, আদর এবং অভ্যর্থনা পেয়েছে, বাড়ির একজনের মতো! থেকেছে । দিনে দিনে পরিজনের সংখা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ-সমস্তর মূলে একজনের অক্লান্ত অধ্যবসায় পরিশ্রম আর মান্ৃষের সংসারে প্রতিষ্ঠালাভ করবার একান্তিক নিষ্ঠা। সমাজে মেসোমশাই-এর প্রতিষ্ঠা বেড়েছে দিন দিন, কোর্টে পসার বৃদ্ধি পেয়েছে, পদোননতি হয়েছে। সম্মানের সবৌচ্চ শিখরে উঠেছে একদিন। কিন্ত যখন দিন গেলে পাঁচ টাক। এনে মাসিমার হাতে তুলে দিয়েছে তখনও যা, যেদিন পাঁচ হাজার এনে তুলে দিয়েছে সেদিও তাই। সে-টাকায় সংসারেরই শুধু সমৃদ্ধি হয়েছে, ছেলে-মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদের বাহার বেড়েছে, কিন্ত মেসোমশাই-এর পরিশ্রমেরও হ্বাস-বুদ্ধি হয়নি; মাসিমার কাছে কোনোদিন কোনো মধাদারও তারতম্য হয়নি ; মাসিমা ছেলেমেয়েদের খাওয়ার তদারক যতখানি করেছে ততখানি করেনি মেসোমশাই-এর | মাসিমা সন্ধ্যে হতেই হুকুম দিয়েছে খোকাবাবু আজ লুচি খাবে, মনে থাঁকে যেন ঠাকুর; আর মণ্টর মাছের তরকারিতে যেন ঝাল দিয়ে বোস না। কম্ঠাপক্ষ ১৩৩ ঠাকুর হয়ত বলেছে, “বাবুর খাবারট। আগে দিয়ে দেব, মা? মাসিমা ঝাঝিয়ে উঠে বলেছে, “বাবুর খাবার পরে হবে, খোকাবাবু ঘুমিয়ে পড়লে আর খেতে চায় না, জানো না? বড়ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রিত বু লৌকজন এসে খেয়ে দেয়ে গেল। হাজার লোকের খাওয়ার আয়োজন হয়েছিল । রাত তখন বাঁরোট।। সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে যাবার আয়োজন করছে । হঠাৎ কে যেন বললে, “বড়- বাবু তো! কই খান্নি ।” খবর পেয়ে সবাই লজ্জিত সঙ্কুচিত । মাসিম! খাবার ঘরের সামনে এসে অত লোকের সামনে বললে, হ্যা গা, তোমায় অকন্মা বলি কি সাধে, খেতে ভূলে গেলে কী বলে তুমি? এইটুকু উপকার তোমায় দিয়ে হয় না, আমার কি একটা কাজ, আমি একলা মানুষ কত দিকে নজর দেব ? কত জায়গায় একে একে বদলি হল মেসোমশাই । মেসোমশাই-এর কোর্টে যাবার কথা কিন্তু কারো মনে থাকে না সচরাচর । ঠিক সময়ে খাবার দেওয়ার কথাও কেউ ভাবে না । ঠিক সময়ে তৈরি হয়ে এসে মেসৌ- মশাই দেখে খাবারের কোনও আয়োজন হয়নি । মাসিমা! এসে হাজির হয়। বলে, যখন একলা এই শরীরে সংসার ঠেলেছি, তখন তো কই ভাত দিতে কখনও দেরি হয়নি, এখন কেন হয় ? মেসোমশাই বলে, “কেন হয় তা তুমিই জানো ।” মাসিমী বলে, আমার জানতে বয়ে গেছে, তুমিই দেখ, গাদা গাদা লোক রেখেছ, বোঝ এখন যে আমার মত গিন্ী পেয়েছিলে বলেই তুমি এ-যাত্রা! টিকে গেলে । তুমি কি ভেবেছ চিরট কাল তোমার সংসারে বাদিগিরি করবো বলেই জন্মেছি, আমার আর নিজের সুখ-আহ্লাদ বলে কিছু নেই? পারবো না আমি দেখতে তোমার ভুতের সংসার, তুমি থাঁকো। তোমার সংসার নিয়ে, আমি পারব না! যতদিন গতর ছিল দেখেছিলাম, আর নয়, ঢের হয়েছে সংসার করার সাধ আমার খুব মিটে গেছে--।' সারে শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে মাসিমারও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে দেখতাম । ১৩১ কন্তাপক্ষ মাসিমাকে দেখলেও আর চিনতে না পারার কথা৷ নাতি-নাতনী, পুত্র- পৌত্র, পুত্রবধূদের ঘিরে বিকেলবেলা মাঁসিম! যখন বারান্দায় বসে, তখন সে এক দৃষ্ত। এক বউম। মাসিমার চুল বেঁধে দিচ্ছে, আর একজন সামনে বসে তরকারি কুটছে শাশুড়ীকে জিগ্যেস করে করে । মণ্টর কপির তরকারিতে গরমমসলা দিতে বাঁরণ করো ছোট বউমা ।, 'থুকুর বাটিতে আজ যেন ছুধ রেখো না, কদিন থেকে পেটের অসুখ করেছে, তোমরা তে। কেউ দেখবে না-_, | “ভোলা! আজ লুচি খাবে না বলেছে, ওর জন্যে তিজেল হাড়িতে এক মুঠো ভাত করে দিয়ো।। 'পল্টুর ছুধটা৷ একটু ঘন করবে ঠাকুর, পাতলা ছুধ খেতে পারে না ও, জানো তো।? এমনি তদারক চলে মাসিমার সার। দিন ধরে। হঠাৎ হয়ত কেউ বললে, “মা, কর্তাবাবু কোর্টে চাবি নিয়ে যেতে ভূলে গেছেন। মাসিমী বলে, 'জানিনে বাপু, সারাদিন কোন্‌ রাজকাজ্য করেন ভগবান জানে। আমার শতেক কাজ, এত ঝঞ্কাটের মধ্যে কর্তার চাবির কথা সে- ও আমাকেই ভাবতে হবে, পারব না আমি অত। সংসারের একটা কুটে। নেড়ে তো ও-মান্থুষের উপ গাঁর নেই, বাইরে বাইরে কেবল গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন, আর আমার ঘাড়ে সংসার চাপিয়ে দিয়ে মজা দেখছেন ! পারব না আমি, যার ঘ। খুশি করুক, খবরদার, আমাঁকে কেউ কিছু বলতে আসিসনি, ভালো হবে না ।। তা এমনি করে মাসিমার দাম্পত্য-জীবন কত বছর চলতো! কে জানে । সংসার তখন জম-জমাট। মেসোমশাই প্রতিষ্ঠার সুউচ্চ শিখরে উঠেছে। মাসিমারও চুল পেকে গেছে। সম্পদ আর এশ্বর্ষের সীম! নেই। এমন সময় মেসোমশাই হঠাৎ রোগে পড়ল। ভীষণ রোগ । সকাঁলবেল! কল- ঘরে গিয়ে কী যে হল আর বেরোয় না। শেষে জান! গেল কপালের শিরা কন্তাপক্ষ ১৩২ ছি'ড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে । আত্মীয়-স্বজন যে-যেখানে আছে সবাই ছুটে গেল। মাকে সঙ্গে নিয়ে আমিও ছুটে গেলাম খবর পেয়ে । সমস্ত বাড়িতেই একট। থমথমে ভাব। ঝি-চাকর, নাতি-নাতনী সবাই সন্তস্ত। শুনলাম মাসিম। সেই যে মেসোমশাই-এর পাশে গিয়ে বসেছে আজ দু'দিন, আর ওঠেনি । নাওয়া খাওয়া নেই। কারে কথা শুনবে না। সবাই বলে বলে হার মেনেছে । মাকে দেখে মাসিমা উঠে এল । চোখে জল নেই । শুকনো খট্খটে । রাগে যেন চোখ ছু*টে। শুধু লাল জবাফুল হয়ে আছে। বললে, “এসেছিস্‌ তুই, দেখে যা ও-মান্ুষের কাণ্ড সংসারের একটা উপ গার কর! দূরে থাক, এই অসুখে পড়ে আমাকে একেবারে জ্বালিয়ে খাচ্ছেন। ও-মামুষ কি সোজ। মানুষ ভেবেছিস, আমার ঘাড়ে সংসার চাপিয়ে দিয়ে নাচতে নাচতে এখন পালাবার মতলব ওর মা বললে, “রাঙাদি, তুমি নিজের শরীরটার দিকে একবার চেয়ে দেখ ৷” মাসিমা বললে, আমার নিজের শরীরের কথা ভাবব, তাহলে যে আমার সুখ হবে রে--। আমার সুখ দেখলে ও-মান্ুষের বরাবর পিত্তি জলে যায়, আমার হবে স্থুখ, বিয়ে হওয়। এস্তেক চিরটা কাল আমায় জবালিয়েছে ও-মানুষ। সুখ বলে কী দ্রব্য জীবনে জানতে পারিনি--সুখের আমার হয়েছে কী বোন, সারাট। জীবন আমায় 'জ্বালিয়েছেন, এখন মরে গিয়ে পর্ষস্ত আমায় জবালাবার মতলব ওর--উনি কি সোজা মানুষ ভেবেছিস ? মাসিমার শেষ জীবনটাও আমরা দেখেছি । মেসোমশীই মারা যাবার আগে তার যাবতীয় সম্পত্তি মাসিমার নামে লিখে দিয়েছিল । ভবানীপুরের বিরাট বাড়ি। নগদে আর স্থাবর অস্থাবরে মিলিয়ে প্রায় সাত লক্ষ টাকার সম্পত্তি ! ছেলেদের আগেই মানুষ করে গিয়েছিল মেসোমশাই | সব মেয়ে- দের বিয়েও দিয়ে দেওয়। হয়েছিল শেষ পর্যন্ত । কোথাও কোনও ক্রুটি নেই। মাসিমা বলত, মরণ আমার, সারাজীবন এক দণ্ড সুখ দেয়নি সে- মানুষ, ওর সম্পত্তি নিয়ে আমি রাজা হব, দেখিস, আমি ওর সম্পত্তির ১৩৩ | কন্তাঁপক্ষ একট পয়স। ছূ"চ্ছিনে হাত দিয়ে, আমার সোনার টুকরো ছেলের! বেঁচে থাকুক, ছেলেরা থাকতে কর্তার পয়সায় আমার দরকার নেই মা, আমি কর্তার পয়সার কখনও পিত্যেশ করিনি, আর করবও না” তা সত্যিই, মাসিম। মেসোমশাই-এর পয়সার প্রত্যাশ! করেনি । আমাদের দেশে যখন যাই, বড় হাসপাতালটার দিকে চেয়ে আমার সব কথা মনে পড়ে যায়, মেসোমশাই-এর নামেই হাসপাতাল । মেসোমশাই-এর সেই প্রাসাদতুল্য বাড়িটা মায় সমস্ত সাত লাখ টাকার. সম্পন্তি, সব মাসিম1 দান করে গিয়েছিল । শেষ জীবনট। ছেলেদের ছোট বাড়িতে কেটেছে তার। অতবড় বাড়িতে ওই এশ্বর্ষের মধ্যে এতদিন কাটিয়েও এখানে কোনও অন্ুুবিধে হত না । মেসোমশাই-এর নামে হাসপাতাল যেদিন প্রতিষ্ঠা হল সেদিনও মাসিম। একবার দেখতে গেল না । যাঁর টাকা তারই নামে হাসপাতাল। প্রকাণ্ড মিটিং হল। মেসোমশাই-এর গুণকীর্তন করে কত লোক কত কী বক্তৃতা দিলে । সামান্য অবস্থা থেকে কেমন করে ধনী হয়েছিলেন সেই ইতিহাস। এতটুকু অহঙ্কার ছিল না, বিদ্বেষ ছিল না। অনলস কর্মপ্রাণ মহাপুরুষ । কর্মই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান নিদিধ্যাসস। জীবনে এক মুহুর্তের জন্যে তিনি অলস হননি। প্রতিটি মুহুর্ত তার কর্ম-সাধনায় কেটেছে । তিনি কর্মপ্রাণ, কর্মপ্রতীক, কর্মবীর মানুষ । শেষে তাঁর বিধব। স্ত্রীর দানশীলতা৷ ও অচল! পতিভক্তির জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েও একটা প্রস্তাব পাঠ করা হল সভায়। আদর্শ হিন্দু রমণী হিসেবে মাসিমার নামও লেখ! রইল হাসপাতালের খাতায়। তবু হাসপাতালটার দিকে চাইলেই আমার কেবল মনে পড়ত মাসিমার কথাগুলো, “সারাজীবন আমাকে জালিয়ে খেয়েছে রে সে-মানুষ, আর তার টাকা ছোঁবো আমি, ওই অকম্ম। লোকের হাতে পড়ে আমার সারাজীবন জলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে, আমার সোনার টুকরে। ছেলের! বেঁচে থাক, তাঁদের খুদকুড়ো যা জোটে তা-ই খাবো, তবু সে-মান্থুষের টাকা আমি ছু'চ্ছিনে, দেখে নিস তুই-_+ কন্তাপক্ষ ১৩৪. চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন আর একুশ বছরের বিধবাজীবন__-এই এতদিনের একনিষ্ঠ পতিনিন্দার পরে যথারীতি একদিন সকালে মাসিমার মৃত্যুর খবর শুনে চম্কেও উঠেছিলাম মনে আছে। মনে আছে এ-সব ছোটবেলাকার ঘটনা । এর পরে কত রকম রকম- ফের।হয়েছে সমাঁজ-জীবনে | যে-সব মেয়েরা বরাবর বিয়ে করে সংসার করা'র জন্যে তৈরি হচ্ছিল, তাঁরাই এসে দলে দলে সরকারী অফিসে ঢুকেছে একদ্িন। নানারকম পার্টিতে যোগ দিয়েছে । ধর্মঘট, শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে । মেয়েরা এগিয়ে এসে সামনে চীড়িয়েছে। জাস্টিস চৌধুরীর মেয়ে লোক-নৃত্য দেখিয়েছে স্টেজে উঠে। যারা কখনও মোটর ছাড়া চলেনি, দাঙ্গার সময় তারাই এসে নারী-কর্মা-সজ্ঘ গড়ে তুলেছে । দল বেঁধে মিছিল করে চৌরঙ্গী দিয়ে লাল-নিশান উড়িয়ে চলেছে । সে আর এক জগৎ, আর এক অধ্যায় । আমার 'কন্যাপক্ষ'তে একবার তাদের কথা! বল! হল না। আর তাদের ক'জনকেই ব৷ দেখেছি এক মিলি মল্লিক ছাড়া সব পাড়াতেই যেমন এক-একটা বাড়ি থাকে, যেখানে একটা-ছুটে। মেয়ের জন্তে পঞ্চাশট। ছেলের জটলা! । আর মিলি মল্লিক নিজে না বললে, আমি-ই কি তার সেই অতীত পরিচয় জানতাম, ন। উষাপতিই জানতো । অমরেশের আখড়ায় উধাপতিও ছিল একজন পাণ্ডা। কিন্তু সে-কথা পরে বলবো । আর সে-সময়ে আমিই কি কলকাতায় ছিলাম! লেখাই তো ছেড়ে দিয়েছিলাম বছর দশেক। সোনাদির কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে লেখা আর ছাপাবো না। লিখবো, পড়বো, সাধনা করবো কিন্তু ছাপিয়ে নাম কলঙ্কিত করবে৷ না। দশ বছর পড়ে তখন যদ্দি সোনাদি অন্থুমতি দেয় তো ছাপাবো আবার । সোনাদি বলেছিল, “মহাভারতের পাণ্ডবদের মতো এই দশট। বছর তোর উদ্ভোগপর্ব ধরে নে, এই দশট বছর তোর অজ্ঞাতবাসের পালা মনে কর।, সোনাদির সামনে বসে বলেছিলাম, তাই হবে সোনাদি !, ১৩৫ কন্তাপক্ষ তারপর বলেছিলাম, “কিন্ত বন্ধুরা যে অনেক বই লিখে ফেলবে তত- দিনে ? তা লিখুক, কিন্তু শেষে যদি একখান তেমন বই লিখতে পারিস, তো সকলকে যে টপকে যাবি তুই আবার ।, যা হোক, সেদিনের সে-গ্রতিজ্ঞা আমি রেখেছিলাম বৈকি। কিন্তু সেই দশ বছরে এমন কাণ্ড হবে কে জানতে। ! এমন করে সব উল্টে-পাণ্টে যাবে। এমন করে নিজের জীবন দিয়ে সোনাদি লিখতে শিখিয়ে যাঁবে আমাকে । বন্ধুবান্ধবরা লেখা চাইতে কাগজের জন্যে । যাঁরা মুখে কখনও প্রশংসা করেনি আগে, লেখ। বন্ধ করবার পর তার কিন্তু বলতো খাস। মিষ্টি হাত ছিল আপনার ।, একদিন সোনাদি বললে, "এবার থেকে তোর সঙ্গে দেখ হবে না আর।? আশ্চধ হয়ে বললাম, “কেন ? “এখানে তো অনেকদিন হয়ে গেল, এবার জববলপুরে যাবো । “কিন্ত তোমার অস্তুখ যে সারেনি ।? দাঁশসাহেবও সেদিন সেই কথাই বললেন, “তুমি চলে যাবে বলছো, কিন্তু শরীরটা তোমার এখনো যে সারেনি 1, সোনাদি বললে, 'আঁমি ঠিকই আছি, কিন্ত তুমি যেন আবার অত্যাচার স্থরু কোরে না_তোমার যা সহ্য হয় না, সেই সব জিনিস খেতেই তোমার লোভ কেবল ।' দাশসাহেব বললেন, “বল তোমাকে বৃথা, আর ধরে রাখবোই বা কোন্‌ অধিকারে? কিন্তু একটা কথ। জিগ্যেস করি- সংসারে কোনও কিছুর ওপরেই কি তোমার মায় নেই? আমার কথ! বলবে। না, আমি কেউই নই তোমার, নেহাত ছেলে-মেয়েদের পাল্লায় পড়ে একদিন এসে পড়েছিলে তাই, কিন্তু সত্যই কি এ-বাড়ির, ওপরেও তোমার কোনও টান হয়নি ? রতি আর শিশুকে কি একেবারেই ভূলে যেতে পারবে! তারা গরমের ছুটিতে বাড়িতে এলে তাদের কী বোঝাবো ? সোনাদি শুধ হাসতে লাগলো । কন্তাপক্ষ ১৩৬ দাশসাহেব তবু হাল ছাড়লেন না । বললেন, “তোমাকে বলতেই হবে সোনা, পৃথিবীতে এমন কেউ-ই কি নেই যে গর্ব করে বলতে পারে তোমাকে কাছে পেয়েছে? যাকে ছেড়ে চলে যেতে তোমার এক ফৌঁট। জল গড়িয়ে পড়বে চোখ বেয়ে ? সোনাি হাঁসতে হাসতে বললে, “তুমি আজ হঠাৎ এমন করে কথা বলছে। যে ?? দাশসাহেব বললেন, “বলিনি, সে শুধু সাহস হয়নি বলে, কিন্তু কত যে আশ্র্য লেগেছে আমার ! স্বামীনাথবাবু তোমার চিঠি নাঁ পেয়ে কিছু করেন না, তার সংসারের প্রতিটি খুটিনাটি তোমার উপদেশ অন্থ্যায়ী চলে, তার বাড়ির নতুন ঝি-চাকর বহাল হয় বরখাস্ত হয় সে-ও তোমার চিঠির মারফত, তুমি চলে আসে এক কথায় নিজের সংসার ছেড়ে আর একজনের সংসারে । আবার হয়ত একদিন আর একটা অনাত্ীয় সংসারে তুমি এমনি করেই জড়িয়ে পড়বে । এ কেমন তোমার নিয়ম ! যেদিন জববল- পুর থেকে চলে আসি, তুমি চলে এলে আমার সঙ্গে, মনে মনে ভেবেছিলাম বুঝি জিত হল আমার, কিন্তু আমার অন্তরাত্মাই জাঁনে কেবল যে সে আমার কতবড় ভূল ! সোনাদি তেমনি ইজি-চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে ছিল আর হাসছিল। দাশসাহেব আবার বললেন, আর অবাঁক্‌ লাগে স্বামীনাথবাবুকে। কোনো অভিযোগ কোনে অন্থুযোগও কি করতে নেই সে-মানুষটির, রক্ত- মাংসের মান্থষ এমন করে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে জয় করতে পারেন কেমন করে বলতে পারো ? সোনাদি হাসতে হাসতেই বললেন, “তুমি সাহেব মানুষ, তোমার হঠাৎ এ-ভাবাস্তর কেন বলো তো ? “এ তোমার উত্তর এড়িয়ে যাওয়া, সোনা ।, এমনি করে উত্তর এড়িয়েই গেছে সোনাদি বরাবর । আমি পাশে বসে শুনেছি। নেহাত ছোট ছেলে বলে কখনও কেউ আমার উপস্থিতিতে ১৩৭ কন্ঠাপক্ষ আপত্তি করেনি। আর দাশসাহেব তো আমাকে আমলই দিতেন না । আমি এসব কথা চুপ করেই বরাবর শুনে গেছি। আর দরকার হলে শুধু খাতায় টুকে রেখেছি ছু-একটা৷ টুকিটাকি কথা । মনে আছে তখন সব তোড়জোড় হয়ে গেছে । জিনিসপত্র সব বাঁধা- ছাদা প্রস্তুত। সোনাদি ইজি-চেয়ারে বসে তদারক করছে। দাশসাহেব অফিসে! অভিলাষ বাঁক্স গুছিয়ে রাখছে । সোনাঁদি চলে যাবে, মনটা কেমন খারাপ লাগলো । | সোনাদি বলছিল, “সারাজীবন কত লোককে হারাবি, কত লোককে পাবি, কত লোক ভালবাঁসবে, কত লোঁক আবার আঘাত, দেবে--এই হারানো, এই পাওয়া, এই ভালবাসা, এই আঘাত, এই নিয়েই তে! জীবন ; এই সব দেখেই তে! একদিন প্রজ্ঞা আসবে, তবেই তো লেখক হতে পারবি তবেই তো... এমনি সময়েই সেই লোকটা এসে হাজির । গেট্‌-এর কাছে গিয়ে বললাম, “কাকে চাই ? “একটা চিঠি এনেছি স্বামীনাথবাবুর কাছ থেকে ।? লোকট। চলে গেল। চিঠিটা পড়ে সোনাদি কী যেন ভাবতে লাগলে খানিকক্ষণ । তারপর টেলিফোন তুলে দাশসাহেবের সঙ্গে অফিসে কথা বলতে লাগলে|। | সোনাদি বললে, “তামার গাড়িট। এখুনি পাঠিয়ে দাও, আমি একবার বৌবাজারে যাবো...না, কখন আসবো! কিছু ঠিক নেই ।...তোমার খাবার খেয়ে নিয়ে শুয়ে প'ড়ো»...আমার ফিরতে দেরি হতে পারে ।” আমি জিগ্যেস করলাম,“কোথায় যাবে সোনাদি ? চল্‌, তুইও আমার সঙ্গে যাবি । মনে আছে তখনও জানি না কোথায় যাবে সোনাদি। স্বামীনাথবাবু কোথা থেকে চিঠি পাঠাচ্ছেন, কেন পাঠাচ্ছেন, কী লেখা আছে চিঠিতে, তা-ও দেখতে পাইনি। যখন গাড়ি নিয়ে সোনাদি বৌবাজারের এক গলির ভেতর নামলো! তখনও জানি না। নম্বর খুঁজে পেয়ে সোনাদি কড়া নাঁড়তে কন্ঠাপক্ষ ১৩৮ লাগলো কড়া না-নাড়লেও চলতো । একটু ঠেলতেই দরজা ফাঁক হল সামান্য, আর দেখা গেল একজন বুড়োমান্ুষ সামনের রান্নাঘরে যেন রান্না করছেন। সোনাদির পেছন-পেছন আমি ঢুকলাম ভেতরে । সোনাদিকে দেখে বুড়োমান্ুষটি যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এক নিমেষে । বললেন, “তুমি !, সোনাদি বললে, পপুটু এখন কেমন আছে ? “সেই রকমই, কিন্ত...ঃ কীজানি কেন আমার যেন মনে হল ইনিই স্বামীনাথবাবু। হঠাৎ তার হাঁতের দিকে নজর পড়তেই সোনাদি বললে, “হাত পুড়িয়েছ দেখতে পাচ্ছি। কী দিয়েছ? 'নারকোল তেল, কিন্তু*** সরো। তুমি, একটু চাল-ডাল ফুটিয়ে নেবে তা-ও পারো না, তা পুটুর অস্তুখ হল আর আমাকে একটা খবর পর্যন্ত দিতে পারলে না !, “সময় পেলাম কই? শিমুলতলায় এসেছিলাম ওকে নিয়ে হাওয়া বদলাতে আর হঠাৎ একদিন এই কাও, তাড়াতাড়ি এখানে এনে হাসপাতালে তুললুম, তারপর...ঃ “এতদিন কী করছিলে, দিন পাঁচেক হল তো। এসেছে! ? “কেবল হাসপাতাল আর ঘর করি, আর নিজের ভাতট। ফুটিয়ে নিই !, “নিজের ভাঁতট! যা ফোটাচ্ছ তাঁ-তে1 দেখতে পাচ্ছি, হাত তো! পুড়িয়ে ফেলেছ, ঝি-চাঁকর কাউকেই তো! আনোনি দেখছি, তোমার মতলব কী বলো তো? স্বামীনাথবাবু অপ্রস্তুত হয়ে পাশে াড়িয়ে রইলেন । আর সোনাদি সেই সিক্ষের শাড়ি রাউজ নিয়ে রান্নাঘরের মধ্যে বসলো । এ-সোনাদিকে যেন চেনা যায় না! ভাবা যাঁয় না, একেই দেখেছি দাশসাহেবের পার্টিতে শৌধীন সমাঁজের চুড়োয়। জাস্টিস চৌধুরী, ব্যারিস্টার ব্যানাজি আর মিসেস চ্যাটাঞ্জির সঙ্গে যেমন অবাধে মিশেছে, তেমনি করে এই বৌবাঁজারের ছোট বাস-বাড়ির রান্নাঘরের ভেতরে একাকার হতেও বাধলে! না সোনাদির । স্বামীনাথবাবু এক ফাঁকে বললেন, “তুমি কেমন আছো ? ১৩৯ | কন্ঠাপক্ষ সোনাদি সে-কথার উত্তর দিলে না। বললে, “তোমার হাতে আমার সংসারের ভার ছেড়ে দিয়ে তে! আমি ভারি আরামে আছি! আমি জববলপুরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি আর এদিকে এই কা... তুমি যাবে জববলপুরে £ যাবো না তো! চিরকাল থাকতে এসেছি কলকাতায় ? মনে আছে স্বামীনাথবাবুকে সেই আমার প্রথম দেখা । এতদিন স্বামীনাথবাবুর সন্বন্ধে যা কিছু শুনেছি সোনাদির মুখে সব মিলিয়ে নিচ্ছিলাম । নির্বাক, নিরহঙ্কারী মানুষটির ঠিক এমনি চেহারাই আশ করেছিলাম । এমনি আপত্তিহীন, অভিযোগহীন আত্মনিরশীল উদার একটি ব্যক্তি । যেন সংসারে কাউকে অবিশ্বাস করতে জানেন না। সমস্ত জগৎ তাকে প্রবঞ্চনা করলেও যেন তিনি নিজের আস্থা হারাতে রাজী নন। ধবধবে রং খালি গা, মাথায় কাচা পাক চুল, সমস্ত মিলিয়ে মানুষটিকে যেন পরম আপনার বলে মনে হল। দু'দণ্ডের মধ্যে কী করে যে সোনাদি সব শেষ করলে কে জানে ! সোনাদি যে এমন পাকা সংসারী, দাশসাহেবের বাড়িতে তাকে দেখে তো মনে হয়নি । সোনাদি বললে, “নাও, হল, এরই জন্যে হাঁত পুড়িয়ে, পা? পুড়িয়ে একাকার একেবারে: খাওয়া-দাওয়া শেষ করতেই বেল। গড়িয়ে এল। সোনাদি বললে, “বাড়িভাড়া ঘা! হয়েছে, মিটিয়ে দাও । আর জিনিস- পন্তোর তো! দেখছি কিছুই আনোনি--, স্বামীনাথবাবু যেন কিছুই বুঝতে পারলেন ন!। সোনাদি বললে, টাকা ন। থাকে আমিই পাঠিয়ে দেব কাল, কিন্তু এখন চলো-' স্বামীনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, «কাথায় ? “কোথায় আবার, আমার বাড়িতে । তোমাকে রেখে আবার হাস- পাতালে যেতে হবে এখুনি-১ - কণ্ঠাপক্ষ - ১৪ তারপর সোনাদির বাড়িতেই উঠতে হল। শুধু কি স্বামীনাথবাবু ! অদ্ভুত মেয়ে সোনাদি ! পু'টু যেদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল, সে-ও সেদিন উঠলো ওখানে । দাঁশসাহেবের বিছানাতেই শোবার ব্যবস্থা হল স্বামীনাথবাবুর। দীশসাহেব বাইরের ছোট ঘরটায় আশ্রয় নিলেন। আর অসুস্থ পু'টু রইলো সোনাদির ঘরের আলাদা একটা। বিছানাঁয়। এ এক অদ্ভুত সংসার । এ-সংসারের মতো। এমন অদ্ভুত দৃশ্য কোথাও আর দেখিনি পরে। পরে যখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, ঝি চাকর বাবুচি দারোয়ান ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তখনও.**কিস্ত সে-কথা। পরে বলবে সময়মতো । ত1 সেই বাড়িতেই দেখেছি লম্বা খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে । ছুটির দিনের তুপুরবেলা। সোনাদি টেবিলটার মাথায় বসে সকলের তদারক করছে। একপাশে স্বামীনাথবাবু বসেছেন আর একপাশে দাশসাহেব। আর ও-পাশে পুঁটু, রতি, শিশু । ইস্কুলের ছুটিতে তারাও বাড়ি এসেছে । মাঝপথেই রতি হাত গুটিয়ে বসেছে । সোনাদি বললে, “তুই কিছু খাচ্ছিসনে কেন রে ? “পেট-ব্যথা করছে মা !, দাশসাহেবকে লক্ষ্য করে সোনাদি বললে, শুনছে বাগানের পেয়ারা- গাছের একট। পেয়ারাও রাখেনি ওই তিনটেতে 1, দাশসাহেব খেতে খেতে বললেন, “তুমি কিছু বলে! না কেন ?' স্বামীনাথবাবু মুখ তুলে বললেন, “আমিও একটা খেয়েছি । দাশসাহেব হেসে উঠলেন, আপনিও খেয়েছেন নাকি পেয়ারা ? স্বামীনাথবাবুও হাসলেন, হ্যা, দিলে যে ওরা-কাশীর পেয়ারা, খেতে ভালো ।, আমাকে দেখিয়ে দাশসাহেব বললেন, “ওই পেয়ারাগাছতলায় ওদের কুস্তির আখড়া ছিল, মাটিটা খুব সারালেো। কিনা, ফল ফলে ভালো ।” স্বামীনাথবাবু আমাকে বললেন, “তুমি কুস্তি করতে নাকি ? বললাম, তখন করতাম | ১৪১ কম্ঠাপক্ষ স্ব'মীনাথবাবু বললেন, “বেশ; তা৷ অভ্যেসট। ছেড়ো৷ না, ওতে শরীর মন দুই-ই ভালো থাকে । সোনাদি একবার বললে, "তুমি অত খাচ্ছ যষে?' স্বামীনাথবাবু বললেন, কে আমি? আমাকে বলছ ? তুমি না, দাশসাহেবকে বলছি | দাশসাহের মুখ তুললেন, আমি ? হ্যা, তোমার কথাই তো। বলছি, শেষকালে প্রেসার বেড়েছে বলে যেন কান্নাকাটি কোরো না আবার ।” স্বামীনাথবাবু বললেন, “তা তে বটে, আপনার বেশি অত্যাচার কর! ভালো নয়, সোনা বলেছে ঠিক” দাশসাহেব বললেন, “মাঝে মাঝে ভুলে গিয়ে বেশি খেয়ে ফেলি-_ সোনাদ্রি (বললে, 'রতি-শিশুকে তবু বকলে শোনে, যত বয়েস হচ্ছে, ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছে! দিন দিন-*'; এমনি করে এক সময়ে খাওয়ার পাট চুকতো । তারপর যাঁর যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তো সবাই। তখন ইজি-চয়ারে চুল এলিয়ে দিয়ে বসতো! সোনাদি। আর আমি পাঁশে বসে-বসে আমার কাজ করতুম। নিজের অভিমান, ছুঃখ, আনন্দ সব কিছু জানাবার একমাত্র মানুষ। সোনাদি জিগ্যেস করতো, আর ছাঁপাতে দিসনি তো। লেখা ? বলতাম, “না সোনাঁদি ।? “সত্যি কথা £ “সত্যি, তুমি দেখে নিয়ো, দশ বছর পরে যা লিখবো, দেখবে নতুন জিনিস, সবাইকে চমকে দেব_-তখন তোমাকে ভালো বলতেই হবে, দশটা! বছর দেখতে দেখতে যাবে.** কিন্ত আজ ভাবি, সেই দশ বছরে কি কম অদল-বদলট হল | কোথায় রইল সোনাদি আর কোথায় রইলাম আমি । কোথায় গেলেন স্বামীনাথ- বাবু! আর কোথায়ই বা গেলেন দাশসাহেব ! চেষ্টা করলে আজো যেন দেখতে পাই চোখ মেলে । কন্তাপক্ষ ই এর পর আমি কলেজের লেখাপড়া শেষ করেছি। ঘটনাচক্রে চাকরি নিয়ে বিলাসপুরে গেছি। বন্ধুবান্ধব লেখার জন্যে তাগাদা দিয়েছে । কেউ কেউ না-লেখার জন্যে অভিযোগ করেছে, অন্থযৌগ করেছে। কিন্তু কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি । মাঝে মাঝে কলকাতায় এসেছি বটে, কিন্তু লেখক কি সম্পাদক বন্ধুদের সঙ্গে দেখাও করিনি । পাছে প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হয়। পাছে সোনাদির কাছে দেওয়া কথার খেলাপ করতে হয়। সেই দশ বছরে পাঠক সমাজ আমাকে ভূলে গেল। সাহিত্য-জগং থেকে আমার নির্বাসন হল বল! চলে। সে দশ বছর আমার জীবনে অজ্ঞাতবাসের পালা । নব- জন্মের উদ্ভোগ পর্ব । আমি নতুন করে দেখছি । নতুন করে শিখছি ! খণ্ড কল্পনার ছলনায় আর ভূলব না । অখণ্ডকে অন্ভব করবো! আমার এই আমি সেই দশ বছরে পরম-আমির মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো । মনে আছে সেই দশ বছরেই প্রথম জীবনকে নতুন করে দেখার দৃষ্টি পেলাম ! আমার তৃতীয় নেত্র খুললো । আর সোনাদি ? কিন্ত সোনাদির কথ! বলবার আগে পলাঁশপুরের মিলি মল্লিকের গল্পট। আমি বলে নিই। পরে বলবার আর ফুরস্তুত পাবে না। মনে আছে সেদিন মিলি মল্লিকের গল্পটা লেখবার লোভ আমি অতি কষ্টে সামলে নিয়েছিলাম । তবু আজ এতদিন পরে আমার নোট খাতা থেকে উদ্ধার করতে আপত্তি নেই। আসলে এটা উবাপতির বৌকে নিয়ে লেখা । আমাদের কুস্তির আখড়ার উষাপতি। অমরেশের মতো! উষাপতিও চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। রেলের চাকরি তার। একরাত্রের জন্যে উযাপতির পলাশপুরের রেলকোয়াটারে অতিথি হয়েছিলাম । আর সেই রাত্রেই একটা হীরের টুকরে। কুড়িয়ে পেলাম আমার শোবার ঘরে। মাত্র ছু'রতি ওজনের এক টুকরো হীরে। তাই নিয়েই একটা গল্প মাথায় এসেছিল । গল্পট! লেখবার আগে উধাপতিকে একটা চিঠি লিখে- ছিলাম তার অনুমতি চেয়ে। উষাপতি উত্তরে লিখেছিল, “সতীকে নিয়ে গল্প তুই লিখতে পারিস, ১৪৩ কন্যাপক্ষ তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু দেখিস ভাই, যাঁতে সতীর কোনে ছুন্ণাম হয় ব। বদনাম হয় আমাদের, এমন কিছু লিখিস নে। জানিস তো, মেয়েমান্ুষের মন, চট করে এমন কাণ্ড করে বসবে- আরো অনেক কথা লিখেছিল। উাঁপতি তখন ছিল পলাশপুরের স্টেশন-মাস্টার। এখন বদলি হয়েছে রায়গড়ে । মাইনেও অনেক বেড়েছে । ছু'পয়সা এদিক-ওদিক থেকেও আসে । নিজেও বিশেষ খরচে-স্বভাবের লোক নয়। কিন্তু চিঠির শেষে লিখেছে, তোদের ওখানে যদি ভালো কোনো ডাক্তার থাকে, একটু খবর নিয়ে জানাঁস, সতীকে চিকিৎসা করাতে চাই । অনেক ডাক্তার, বছ্ধি, হাকিম, সাধুকে দেখালাম__খরচও হচ্ছে প্রচুর-- কিন্তু কিছুই হচ্ছে না” উধাপতির অনুমতি নিয়ে গল্পটা লিখতে আরন্ত করেছিলাম বটে । কিন্ত লিখতে গিয়ে হঠাৎ কেমন হাসি এল । সতীকে নিয়েই গল্পটা বটে ! উষাপতিকে অবশ্য জানাইনি ছু'রতি ওজনের হীরের কথা । জানিয়েছিলাম, সতীই আমার গল্পের নায়িকা । কিন্তু আসলে তে। জানি যে, সতী আমার গল্পের উপনায়িকা ছাঁড়ী আর অন্য কিছুই নয়। শকুস্তলার যেমন প্রিয়ন্থদা ! কিন্তু সেই রাত্রের অন্ধকারে আমার ঘরে কে এসেছিল ? এ-গল্পের নায়িকা, ন। উপনায়িক ? সত্যি সেই রাতটার মধ্যেও যেন কিছু মোহ ছিল। সেটা বুঝি ফাল্তনী-পুধিমার রাত। জীবনে কতদিন জীবিকার জন্যে রাতের পর রাত কাটিয়েছি তার হিসেব নেই । অফিসের চারটে দেওয়ালের মধ্যে কাজ করতে করতে অনেকবার বাইরে চেয়ে দেখেছি । কেমন করে রাতের গাঢ় অন্ধকার পাতল। হয়ে নীল হয়, সেই নীল কেমন করে সাদা হয় তাও লক্ষ্য করেছি। কিন্তু তবু মনে হয়েছে রোজই যেন নতুন দৃশ্য দেখেছি । দশ বছর আগের সেই রাতট। যেন আজে আমার জীবনে অনন্য আর একক হয়ে রয়েছে । পলাশপুরের স্টেশন-মাস্টারের বাঙলোর সেই সঙ্গীহীন ঘরে সারারাত তো আমার অনিদ্রাতেই কেটেছিল। তবু সকালবেলা জলখাবার খেতে বসে উষাপতি অবাক হয়ে গিয়েছিল আমার চেহার। দেখে । কন্ঠাপক্ষ ১৪৪ বলেছিল, “রাত্রে তোর ঘুম হয়নি নাকি ? বলেছিলাম, “না ।, উধাঁপতি বলেছিল, “আমারও হয়নি |; কীজানি কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল। বলেছিলাম, “কেন, তোর হয়নি কেন? উষবাপতি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল:"' কিন্তু যা বলেছিল, তা বলবার আগে গোড়া থেকে সমস্ত ঘটনাটাই বলা দরকার । উধাপতি তখন সবে বদলি হয়েছে পলাশপুরে । নতুন বিয়ে করে সংসার পেতেছিল ওখানে । ওর অনেকদিনের সাধ ছিল আমাকে ওর বউ দ্রেখায়। চিঠিতে লিখেছিল কতবার । নাকি বেশ নিরিবিলি জায়গ।। অন্তত কলকাতার চেয়ে নিশ্চয়ই নিরিবিলি । চার-পাচটা কলিয়াঁরীর সাইডিং শুধু বেরিয়ে গেছে স্টেশন থেকে । কোলিয়ারী ছাড়া স্টেশনের আর কোনে উপযোগিতাও ছিল না । মাঝে মাঝে চিঠি লিখতো আমাকে, 'এবার শীতকালে নিশ্চয়ই আসিস। তোর জন্যে সব রকমের ব্যবস্থা করে রেখেছি ।: কিন্ত যাওয়া আর আমার হয়ে ওঠেনি । উষাপতি যখনই ছুটিতে এসেছে, দেখা করেছে আমার সঙ্গে । বলেছে, আমার ওখানে গেলি না৷ তে! একবার |, বিশেষ করে, স্টেশন-মাস্টারের বাঁড়িতে অতিথি হওয়ার একট লোভও ছিল বরাবর। মুরগি, মাছ, ডিম, ঘি--সবই স্টেশন-মাস্টারের প্রায় বিনা- পয়সায় প্রাপ্য । আকারে-প্রকারে উষাপতি আমাকে জানিয়েও দিয়েছে সে-কথা। কিন্তু নিজের কোটর ছেড়ে নড়া-চড়া করার সুবিধে কখনও হয়ে ওঠেনি বলে যাওয়াও হয়নি ওর কাছে। কিন্ত সেবার বন্ধে যাবার পথে কেমন করে যে কাট্নী স্টেশনে হঠাৎ নেমে পড়লাম, তা নিজেই জানি না। কাট্‌নী থেকে কয়েকটা স্টেশন গেলেই পলাশপুর। ব্রাঞ্চ লাইনের ট্রেন। একটা রাত থাকবো ওখানে, তারপর পরদিন আবার ফিরবো । এই-ই ছিল মতলব। ১৪৫ কন্ঠাপক্ষ যখন গিয়ে পলাশপুরে পৌছলাম তখন বিকেল । স্টেশনে দাড়িয়ে ছিল উষাপতি। সাদা গলাবন্ধ কোট পরলেও চিনতে কষ্ট হল না। আমাকে দেখেই একেবারে জড়িয়ে ধরেছে । বললাম, “কিন্ত কালকেই আমাকে ছেড়ে দিতে হবে ভাই, ভীষণ কাজ-_ “সে হবে না” বলে কাকে যেন হুকুম দ্রিলে আমার মাঁলপত্তোর বাড়িতে নিয়ে যেতে । তা পলাশপুর বেশ বড় স্টেশন। সব গাড়ি জল নেয় এখানে । বাইরে বিরাট একট খেলার মাঠ। জাঁফরি-দেওয়া বড় বড় বাঁলো। রাস্তায় ফিরিঙ্গী সাহেব-মেমদের ভিড়। সাইকেল-রিকৃশার চল্‌ আছে বেশ এদ্রিকে। বিকেলবেলার গাড়ি দেখতে প্র্যাটফরমে টাউনের লোক এস জুটেছে। গাড়ি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবাঁর সব চলে গেল প্ল্যাটফরম থেকে । ফীকা স্টেশন। উষাপতির হাজার কাজ। দশজনকে হুকুম দিতে হয়। দশজনকে শাসন করতে হয় । কাজের ফাকে একবার বললে, আর একটু বোস, একসঙ্গে যানে বাড়িতে--আর এই কাজটা সেরে নি।, শেষ পর্ষস্ত একসময় কাঁজ সেরে উঠলে। উষাপতি । বললে, 'আর পাঁরিনে কাজের ঠেলায়! এই দেখ না, তুই এলি, তোর সঙ্গে একটু ভালো করে কথা পধন্ত বলতে পারলাম না-যা হোক, তারপর কাল কিন্তু তোর যাঁওয়। হবে না বলে রাখছি--ওসব ওজর আপত্তি শুনছিনে ।, বললাম, “তা হয় না রে। ওদিকে একদন দেরি হলে ভারি অসুবিধে হবে আবার-- “সে কৈফিয়ত দিস তুই মিলির কাছে, তাঁর হাতে তোকে ছেড়ে দিয়ে আমি খালাস, ভাই-বাড়ির ব্যাপারে আমি নাক গলাই না। বাঁড়ির মধ্যে টুকেছ কি আমার এলাকার বাইরে চলে গেলে--সেখানে মিলির কথাই ফাইন্যাল ৷, পর কন্তাপক্ষ ১৪৬ বললাম, “পুরোপুরি ডিভিসান-অব-লেবার দেখছি ।, উষাপতি সিগ্রেটে টান দিতে দিতে বললে, “না করে উপাঁয় ছিল না, ভাই। আমার অফিসের এত কাজ যে, এর পরে আর বাড়ির কোনো ব্যাপারে মাথ! ঘামাবার ফুরস্থত পাই না, ওট]1 মিলি নিজেই ঘাড়ে নিয়েছে, বলেছে,বাড়ির ব)াপারে আমায় সম্পূর্ণ স্বরাজ দিতে হবে। তা এমন কি, ওর চিঠি পর্যন্ত আমি খুলে পড়তে পারবে না, ও-ও আমার চিঠিপত্র খুলবে না।? তারপর একটু থেমে বললে, "এই যে তুই এলি, কী খাবি না-খাবি,_- সমস্ত ভাবনা! তার। কোথায় শুবি, কী করবি-_-ও নিয়ে আমায় আর মাথা ঘামাতে দেবে না ।? বললাম, “এরকম স্ত্রী পাওয়া তে। সৌভাগ্যের কথা রে ।, উষাপতি হাসলো ৷ বেশ যেন পরিতৃপ্তির হাঁসি । বললে, “ত। জানিনে। তবে যারা এসেছে বাড়িতে, দেখেছে মিলিকে, তার। বলে,আমার নাকি স্বীভাগ্য ভালো । তবে বিয়ে তো একটাই করেছি, তুলনামূলক বিচার করতে পারবে ন। ভাই ॥, উষাপতি আবার বলতে লাগলো, “আমি অবশ্য তোদের অনেক পরে বিয়ে করেছি, বলতে পারিস একটু বুড়ো বয়েসেই । মনে একটা ভয় ছিল বরাবর, এ বয়েসে বিয়ে করে হয়ত আর-একজনকে কষ্ট দেব-_-কিস্তু”"*' কিন্ত” বলে কথাট। আর শেষ করলো না উবাপতি। আত্মতৃপ্তির এক বাজ্ময় হাসিতে আবার ভরে উঠলে। উষাপতির মুখ। সে-হাসি গোপন করতে চেষ্টা করলো না উষাপতি। বললাম, “তাহলে বিয়ে করে খুব সুখী হয়েছিস বল্‌-বিয়ে করবো না বলে যে রকম পণ করেছিলি তুই-_” উষাপতি আবার হাসলে । বললে, “মুখী ?."'তবে আমি মিলিকে বলেছিলাম বি. এ. পরীক্ষাট। দিয়ে দিতে, কারণ বরাবর ফার্স্ট ডিভিসনে পাঁস করে এসেছে-"শেষফকালে আমাকে না দোষ দেয় যে, তোমার জন্তে আমার ডিগ্রীট। পাওয়া হল না! তা কী বলে জানিস--? ১৪৭ কন্ঠাপক্ষ বললাম, “কী বলেন ?' “মিলি বলে." কিন্ত মিলি কী যে বলে তা আর বলা হল না। হঠাৎ ল্যাজ নাড়তে নাড়তে একট। বিলিতী টেরিয়ার কুকুর এসে আপ্যায়ন জানাতে লাগলে! উষাপতিকে । উধাপতি বললে, 'আরে, তুই ঠিক টের পেয়েছিস দেখছি 1, বললাম, “তুই আবার কুকুর পুষেছিস নাকি ? “আরে আমি পুষতে যাবো কেন? মিলির । মিলির ছোটবেলাকার কুকুর, বিয়ের পর এ-ও এসেছে সঙ্গে'*যাক্গে যে-কথা বলছিলাম-” বলে উষাপতি আবার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে এল । গলা নিচু করে হাঁসতে হাঁসতে বললে, “কালকে আমাদের বিয়ের বাষিকী গেছে কিনা-__খুব খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল, কুকুরটা খুব খুশী আছে তাই, তা সেই উপলক্ষে হীরে-বসানো নেকলেস একটা দিয়েছি ভাই মিলিকে-_ আনিয়েছি কলকাতি। থেকে ! তুই একবার দেখিস তো-_বেটার| ঠকালো। না ঠিক দাম নিয়েছে |? বললাম, “কত দাম নিলে? “চোদ্দ শো টাঁক। নিয়েছে অবশ্য, তা নিকৃগে, সে জন্যে কিছু নয়। উপরি পয়স! ওয়াগন পিছু কিছু-কিছু পাঁওয়। যায়, কোলিয়ারী যন্দিন আছে ভাই, টাকার অভাবট। নেই তদ্দিন। তারপরে যদি বদলি করে কখনও কোনো খারাপ স্টেশনে তখন দেখা যাবে, কথা বলতে বলতে উষাপতির বাঁউলোর সামনে এসে গিয়েছিলাম । উষাপতির আভাস পেয়ে বুঝি তার স্ত্রীও এসে দাড়ালো সামনে । আমাকে অবশ্য আশাই করছিল। কারণ আমার স্্ুটকেস, বিছানা আগেই পৌছে গেছে এখানে । কিন্ত উাপতির স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে কেমন যেন থমকে গেলাম । আমাকে দেখে যেন কালে হয়ে এল তাঁর মুখখানা । তবে এক মুহুর্তের জন্যে! এমন কিছু নজরে পড়বার মতো নয় । কন্ঠাপক্ষ ১৪৮ উষাপতি এগিয়ে গিয়ে বললে, এই দেখো, কাকে এনেছি । আমাদের দলের হীরে। এআর ইনি-- আলাপ হল। এবার হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলেন মিলি দেবী। টেবিলে গিয়ে বসলাম । চায়ের সরপ্তাম তৈরি ছিল । চ1 তুলে নিয়ে উাপতি বললে, “কিন্ত ও কী বলছে জানো, ও নাকি কালই চলে যাবে ।, | মিলি দেবী হঠাৎ অবাঁক্‌ হয়ে আমার দিকে চাইলেন, সেকী? তা বললে শুনছি না, কাল আপনার যাওয়া চলবে না।, উষাঁপতি বললে, “এখন তোমার হাতে ভার দিয়ে দিলাম--আমার আর কিছু করবার নেই। যা ভালো বোঝ করো 1 মিলি দেবী হাঁসতে হাসতে বললেন, “তাই নাকি % বললাম, “ক্ষমা করবেন এবার। পরের বার বরং থাকবো যতদিন বলেন, এবারে বিশেষ জরুরী কাজে-; মিলি দেবী বললেন, “বাড়িতে যখন আমার এলাকার মধ্যে এসেছেন, তখন আপনাকে ছ*দ্রিন থেকে যেতেই হবে."*'আমর। বিদেশে পড়ে থাকি, একটু বুঝি দয়া-মায়া নেই আপনাদের ! উষাপতি হাসতে লাগলো । হাঁসতে লাগলাম আমিও । মিলি দেবীও হাঁসতে লাগলেন । কথা বলতে বলতে উষাঁপতি হঠাঁৎ বললে, “তোমার নেকলেসট। দাও তো৷ একবার, দেখাই ।” বললাম, “আমি তে। এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি বেশ--ওর গলাতেই তো! মানাচ্ছে ভালো । কেন আর-_- উষাপতি বললে, “না না, তা কি হয়। হাঁরট? খুলে দাঁও--বেটার! ঠকালো৷ কিন! জেনে নেওয়া ভালো। এ আমাদের ভালো সমঝদার একজন, ওদের ফ্যামিলিতে এ-সব জিনিস আছে অনেক ।, মিলি দেবী নেকলেসটা খুললেন। বেশ চমৎকার জিনিসটা মনে হল। ১৪৯ কন্ঠাপক্ষ দেখে মনে হল, ন্যায্য দামই নিয়েছে । নতুন ডিজাইনের জড়োয়ার কাজ করা হার। ঠিক লকেটের ওপর একট। ছু'রতির হীরে জলজ্বল করছে। হারট। ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, “বড় সুন্দর জিনিস--আপনার পছন্দ আছে বৌদি।, মিলি দেবী খানিক পরে চলে যাবার পর উধাপতি বললে, “বেশি বয়েসে বিয়ে করলে এই সব গুনোগার দ্রিতে হয় ভাই ।: বললাম, “কেন? এ কথা বলছিস কেন? উধাপতি সে-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কী একট। কাজে পাশের ঘরে চলে গেল। আমিও এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে লাগলাম। বড়লোক হয়েছে উ্াপতি এখন । জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । সুন্দরী স্ত্রী পেয়েছে । শুধু সুন্দরী স্ত্রী নয়, সুশিক্ষিত! বিদূধী বল! চলে। হয়ত উবাপতি নিজের এম্বর্ব দেখাতেই আমাকে এতবার আসতে নিমন্ত্রণ করেছিল । তবু খুশি হলাম দেখে যে, তার জীবন সার্থক হয়েছে । বিয়ে করে স্তুখী হয়েছে সে। বাপ- মা-মরা উধাপতি। বড় গরীব ছিল আমাদের দলের মধ্যে । বরাবর ওর উচ্চাশ।, একদিন আমাদের সমান পর্যায়ে এসে দাড়াবে । এতদিন পরে তা সকল হয়েছে । দেখে আনন্দই হল। অনেকদিন আগেকার কথা । ভালো করে সব মনে নেই। শুধু মনে আছে বেশ আনন্দে, হাসিতে, গল্পে কেটে গেল সে-সন্ধেটা। আরো মনে আছে বার বার মিলি দেবী কেবল বলেছেন, “কাল আপনার যাওয়া হবে না তা বলে, আর একট। দিন থাঁকতেই হবে 1; সেই রাত্রেই ঘটনাটা ঘটলো । ঠিক কত রাত্রে বলতে পারবো না । নতুন জায়গায় ঘুম আসছিল ন!। মনে হল ভেজানে৷ দরজাটা! খুলে কে যেন ঘরে ঢুকলো । নিস্তব্ধ রাত। শুধু মাঝে মাঝে রেলের ইঞ্জিনের ফৌসঞোসানি আর আক্রোশের গর্জন কানে আসে। বললাম, কে? ছায়ামৃতি বললে, “আমি-__ কন্তাপক্ষ ১৫৬ বিছানার ওপর সটান উঠে বসেছি। অস্পষ্ট হলেও অনুমান করে নিতে কষ্ট হল না । বললাম, আপনি ! হঠাৎ? মিলি দেবী বলে উঠলেন, আপনি এখানে আসতে পারেন হঠাৎ, আর আমি আসতে পারি না? এ আমার বাঁড়ি, আমার স্বামীর ঘর, আমি এখানে খুব স্থখে ছিলাম-_কেন তুমি এলে? বলো, সত্যি কথা বলো কে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে ? হতচকিত নির্বাক বিস্ময়ে আমার কণ্ঠরোধ হয়ে এল। বললাম, “কী বলছেন আপনি ।, চীৎকার করে না, পাশের ঘরে আমার স্বামী শুয়ে আছেন। তুমি ললিতকে বোলো, মিলি তাকে ভূলে গেছে । কাসারিপাড়া লেন-এর সে- বাঁড়িট। সে-ঘরট। আমার আর মনে নেই, আমি এখন মিলি মল্িক--আমি এখন পরক্্রী...; আবার বললাম, 'আমি কিছু বুঝতে পারছি না, “মিথ্যে কথা বলো না, আমি তোমাদের সবাইকে চিনি। ললিত তোমার ভাগ্নে নয় ? বোটানিক্যাল গার্ডেনে পিকৃনিক করতে আমাদের সঙ্গে যাওনি তুমি ? ইণ্টারমিডিয়েট টেস্ট পরীক্ষ। দিয়ে ট্যাক্সি করে কারা ঘুরিয়েছিল আমাকে! আমরা গরীব ছিলুম, তাই তোমাদের সাহায্য আমরা তখন নিয়েছি। কিন্তু এখন তো৷ আমি বড়লোকের স্ত্রী! এখন তোমাদের প্রয়োজন আমার মিটে গেছে । এখন শাড়ি দিতে এলেও নেব না, গয়না দিতে এলেও নেব না আমি, সিনেম। দেখাতে এলেও যাবে ন! তোমাদের সঙ্গে-__কেন এসেছ তুমি? একজনকে পাগল করে দিয়েছ বলে ভেবেছ আমাকেও করবে? সত্যি বলো তো, কিছু মনে পড়ছে না ?' ললিত নামে কোনে। ভাগ্নে দূরে থাক, ও-নামের কোনে বন্ধুও আমার কোনও কালে ছিল না। কীজানি কী খেয়াল হল, বললাম, “পড়েছে । “ললিত তোমায় পাঠিয়েছে? সত্যি কি না বলো? এবারও বললাম, “হ্যা ।? ১৫১ কন্তাঁপক্ষ আমি তোমাদের সকলকে চিনি, জানতাম ন আমার স্বামীর সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব আছে-_কিন্ত তোমাদের পায়ে পড়ি, আর কখনও এসো না৷ এখানে, যাও, কাল সকালেই চলে যেয়ো এখান থেকে-_বুঝলে ? বললাম, যাবো ।? হ্যা, তাই যেয়ো।। শরীরটাকে একটা ঝাকুনি দিয়ে মিলি দেবী যেমন এসেছিলেন তেমনি চলে গেলেন । তারপর সমস্ত রাত আমার আর ঘুম এল না। মনে হল--কাঁর ভূল? আমার, না, মিলি দেবীর? আর কখনে। কোথাও ওকে দেখেছি বলে তো! মনে পড়ে না। কে ললিত ! কার ভাগ্নে! কবে কার সঙ্গে বোটানিক্যাল গাডেনে ঘুরেছেন। কবে ঘুরে বেড়িয়েছেন ট্যাক্সিতে ! আমার চেহারার সঙ্গে কি অন্য কারো চেহারার বা নামের মিল আছে ? নিজের স্মৃতির অলি- গলি-ঘুঁজি সমস্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনে! কিনারা করতে পারিনি । ভোরবেলাই বিছ্ান। ছেড়ে উঠেছি । উষাপতি তারও আগে উঠেছে । চায়ের টেবিলে পোশাক পরে তৈরি সে। এখনি বোধ হয় ডিউটিতে যাবে। পাশে কালকের মতো মিলি দেবীও বসে। কিন্তু চেহারার মধ্যে কোনো বৈলক্ষণ্য নেই যেন। উষাপতি আমাকে দেখেই বললে, “কাল রাত্রে তোর ঘুম হয়নি নাকি £ এরকম চেহারা কেন রে? বললাম, 'না, নতুন জায়গা বলে হয়ত ।' উষাপতি বললে, আমারও হয়নি ।' জিগ্যেস করলাম, “কেন ? উষাপতি বললো, “সতী কাল রাত্রে বড় বিরক্ত করেছে । সতী! সতী কে? জিগ্যেস করলাম। মিলি দেবী চা ঢালতে ঢালতে বললেন, “আমার দিদি ।' উষাপতি বললে, হ্যা, মিলির দিদি । মাথাট] সম্প্রতি খারাপ হয়েছে, পাগলের মতে লক্ষণ, আমার এখানেই রয়েছে এখন |, কন্ঠাপক্ষ ১৫২ হঠাৎ যেন কেমন সন্দেহ হল। মিলি দেবীর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। শান্ত, পরিতৃপ্ত, সিগ্ধ দৃষ্টি। কাল রাত্রে তবে কি ভুল দেখেছি ! পাগলের প্রলাপ শুনেছি কেবল ? উধাপতি আবার বললে, “মাঝে মাঝে বেশ থাকে, কাল রাত থেকে আবার হঠাৎ কিরকম মাথাটা বিগড়ে গেছে--সার! বাড়িময় ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে, চীৎকার করেছে, বকেছে-কেঁদেছে-, উধাপতি আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখালে । একট। ঘরের ভেতরে ব্ন্ধ। অবিকল মিলি দেবীর মতো। দেখতে । বয়সে ছু'এক বছরের ছোট-বড় হয়ত। ঘরের মধ্যে আপন মনেই বিড়বিড় করে বকছে | উধাপতি বললে, “এখন ওইরকম কিছুদিন থাকবে, তারপর আবার কিছুদিন ভালে। হয়ে যাবে-_ম্বামী নেয় না, তারপর থেকেই...কিন্তু তুই আজকে থাকছিস তে? বললাম, “না ভাই, আজ পারবে না থাকতে ।? উধাপতি মিলির দিকে চেয়ে বললে, “ও কী বলছে শোনো--থাকবে না নাকি আজ ।, মিলি দেবী তেমনি ক্লিগ্ধ হাসিতে উজ্জল হয়ে উঠলেন । বললেন, “তা৷ হবে না, থাকতেই হবে কিন্ত, চাঁ খেতে খেতে হঠাৎ উষাপতি একবার স্ত্রীর দিকে কৌতৃহলী হয়ে যেন কী দেখতে লাগলে। ৷ কাছে গিয়ে গলার নেকলেস্ট। দেখে বললে, “একি ? তোমার লকেটের হীরে কোথায় গেল ?' “কই দেখি? কা সর্বনাশ 1, আমিও দেখলাম । মিলি দেবীও নেকলেসট। খুলে দেখে অবাক্‌ হয়ে গেছেন। তাই তো। কাল সন্ধ্যেবেলাও তে। ছিল সেটা! কোথায় গেল একরাত্রের মধ্যে! খোঁজে তো বিছ্বানাট1 ! বিছানাট। খোজা হল। খোঁজা হল ঘর-দোর। এখানে-ওখানে । ব্যস্ত হয়ে পড়লে উষাপতি। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মিলি দেবী। কোথাও তো যাওনি 1? দেখো! তো! বাথরুমট। ! যাবে কোথায়? ৯৫৩ কন্তা পক্ষ হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে না। শোবার ঘর, হল ঘর, আর নয়তো! বাথরুম ! কিন্তু বুথ! চেষ্টা! সেদিন কোথাও সেই ছু'রতি ওজনের হীরে আর খুঁজে পাওয়া যাঁয়নি। উবাপতি আর মিলি দেবীর কাছে আজ পধন্ত সেটা নিরুদ্দেশ হয়েই আছে হয়ত ! মনে আছে সেদিন কারো অনুরোধ উপরোধ না-শুনেই চলে এসেহিলাম পলাশপুর থেকে । ফিরে এসে গল্পট। সমস্ত লিখে পাঠিয়েছিলাম উবাপতির কাছে। আপত্তির কিছু আছে কিনা জানতে । উত্তরে উধাপতি লিখেছিল, “মিলিও তোর গল্পট। মন দিয়ে পড়েছে । বলেছে,-_গল্পটা ভালে হয়েছে, কিন্তু যেন অসম্পূর্ণ মনে হল লেখাটা । ছৃ'রতি হীরের কথাট। গল্পের পক্ষে অবান্তর হয়ে গেছে নাকি। গল্পের সঙ্গে ওর যোগাযোগ কী বোঝ। গেল ন।, আমি অবগ্ঠ সাহিত্যের কী-ই ব! বুঝি_-যা হোক সেই হীরেট। এখনও পাওয়া যায়নি, পাওয়া যাবেও না বোধহয় |” আজ এক-একবার ভাবি, মিলি দেবীকে চিঠি একটা লিখবে নাকি! লিখবে। নাকি হীরেট। আমার কাছেই আছে। জানিয়ে দেব নাকি যে সেদিন ভোরবেল। নিজের বিছ্ানাট। বাধবার সময় আমার শোবার ঘরেই সেট? কুড়িয়ে পেয়েছিলাম আমি ! সেই ছু'রতি ওজনের হীরেটা। কিন্তু আবার ভাবি, থাক্‌ না। উধাপতি স্ত্রী নিয়ে সুখে ঘর-সংসার করছে। ওদের সংসারে আগুন জ্বেলে লাভ কি! আমার এ গল্প যদি অসম্পূর্ণ থাকে ত থাক --আমি জীবনে আরে! অনেক সম্পূর্ণ গল্প লিখতে পারবো, কিন্তু ওরা সুখে থাকুক। আমার একট! সামান্য গল্পের চেয়ে ওদের জীবন যে অনেক দামী । আজো পলাশপুরের মিলি মল্লিকের গল্পটা! আমার নোট-খাতাতেই বন্দী হয়ে আছে। ও আমি লিখিনি। ও আমি লিখবোও না। মিষ্টিদিদি, কালোজামদিদি, মিছরিবৌদি সকলের গল্পের মতো ও আমার জীবনের শুধু সঞ্চয়ই মাত্র হয়ে থাক। ওর চেয়ে মহৎ কিছু লিখবো । মহত্তর, শ্রেষ্ঠতর কন্তাপক্ষ ১৫৪ কিছু। ওদের অতিক্রম করে নারীত্বের আরো বড় সত্তাকে দেখবো আমি । নারীর অন্তরাত্মাকে আমি খু'জবো। আমার নবজন্মের উদ্ভোগপর্বে সেই হবে একমাত্র উদ্দেশ্ত । আমার দশ বছরের অজ্ঞাতবাস তবেই হবে সার্থক। বিলাসপুরে চলে যাবার আগে সোনাদিকে আমি সেই কথাই দিয়েছিলাম । আমার প্রতিজ্ঞা আমি রেখেছি। কিন্ত বিলাসপুরে যাবার আগে আমি কি জানতাম এমন হবে ! মনে আছে বিলাসপুরের সেই জীবন! কোনও কাঁজ নেই, শুধু চুপ করে দেখা আর শোনা! কেবল ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়াই। কখনো জববলপুর, কখনো কাট্নী, কখনো অন্থুপপুর ৷ কত সব অখ্যাত ইস্টেশান। জঙ্গল, পাহাড় আর বিচিত্র সব মান্ুষ। মনেক্দ্রগড়, চিরিমিরি, নাইনপুর, গণ্ডিয়া, বালাঘাট। অমরকণ্টক রেপ ধরে রেললাইন চলেছে । পেগ রোড। কখনো চড়ি গার্ড সাহেবের ব্রেকভ্যানে। কখনো আইস-ভেগ্ডারদের থার্ড-ক্লাস কামরায় । আবার দরকার হলে কখনো ফার্স্ট ক্লাস কামরার নির্জনে । সে-এক বিচিত্র চাকরি, বিচিত্র জীবন। নিজেকে বড় নগণ্য মনে হল এই পৃথিবীর ভিড়ে। প্রথম উপলব্ধি হল, পৃথিবীটা শুধু কলকাঁতাই নয়। এ-পৃথিবী আরো অনেক বড়। এ ম্যাপ দেখে পৃথিবী দেখা নয়। মানুষ যত বড়ই হোক, মনে হল বিশাল বিশ্ব-প্রকৃতির কাছে সে তুচ্ছ। বড় স্বস্তি পেলাম। নিজের আমাকে আমার মধ্যে খুঁজে পেলাম । সোনাদির কথাই সত্যি মনে হল। সোনাদি বলতো, 'বস্তকে দেখবিনে, সত্যকে দেখবি । বাচ্ছা পাখির যেমন চোখ ফোটার আগেই আলে। দেখবার জহে/ বাসনা হয়, কাকে বলে আলো! তা সে জানে না তখনও, তবু তার বোজ চোখের মধ্যেও সেই আলোর সত্যটা প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে--তেমনি করেই তোর জীবনে সব দেখ! সত্যি হোক 1 সোনাদি আরো বলতো, “জীবনে সুখ নেই বলে ছুঃখ করিস নে। জীবনকে তার সমস্ত স্থখ-ছুঃখ, সমস্ত ক্ষয়-ক্ষতি, সমস্ত উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে যেন ভালোবাসতে পারিস এমন শক্তি পাওয়া চাই ।, ১৫৫ কন্তাপক্ষ আরে। কত কী কথা কতদিন বলেছে, সব কি আজ মনে আছে! একদিন জিগ্যেস করেছিলাম, “তুমি নিজে কোনদিন লিখেছ, সোনাঁদি ?, আমার যেন কেমন মনে হত সোনাদিও এককালে লেখার চেষ্টা করেছে, নইলে এত কথা জানলে কী করে। আমি লিখি বলে কেন এত খাতির করে ! সোনাঁদি বললে, দূর, আমি লিখতে যাবো কেন? বললাম, “তবে যে তুমি এত কথা জানো! কে তোমায় শেখালে ? সোনাদি বলতো, 'সব আমার বাবার কাছে শোনা, বাবাকে তুই দেখিস- নি, দেখলে বুঝতে পারতিস কী অগাধ পাঁণ্ডত্য তার। আমার বাবাও লিখতেন |? জিগ্যেস করেছিলাম, কি লিখতেন, গল্প ? সোনাঁদি বলেছিল, বাবা ছিলেন কিষেনগড়ের দেওয়ান । মনে আছে, ঢালু ডেস্কের ওপর কাগজ নিয়ে দিনরাত লিখে চলেছেন_ শুধু কি গল্প? উপন্যাস, ইতিহাস, সাহিত্য-_কী নয় ? “সে-সব বই কী হল ?, “সে আর ছাপ হয়নি, বাবা ছাঁপতে দিতেন না। কিন্তু আমি তো পড়েছি, ছাঁপলে সে-বই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত বাজারে । কিন্তু বাবার ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।--তিনি লিখবেন, কিন্তু ছাপা হবে না। হয়ত ছাপাও হত, কিষেনগড়ের দেওয়ানের লেখা ছাপাঁবার জন্যে 'রাঁজার ছাপাখানা সব সময়ই খোলা ছিল। রাজাও বলেছিলেন বাবাকে । আমিও বলেছিলাম । বাবা রাঁজী হতেন না, বলতেন,_লিখি আমার আত্মবোধের জন্যে, আত্ম- প্রকাশের জন্যে নয়” সত্যিই বিলাসপুরে সমস্ত দেখে শুনে আমার তাই মনে হত আত্মকোধ ন। হলে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা বুঝি বিড়ম্বনা । এতদিন যেন সেই বিডম্বনাই করে এসেছি । জগতকে না দেখে এতদিন শুধু বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটরি দেখেছি। যাঁর আত্মবোধ হয়েছে, জীবন তার কাছে কত সহজ রূপে ধর! দিয়েছে । যে আত্রূপ দেখেছে সে বিশ্বরূপ দর্শন করেছে। সেখানে কন্ঠা পক্ষ ১৫৬ তর্ক-বিতর্ক নয়, বিজ্ঞান নয়, দর্শন নয়--৫স একটি একের সপ্পুর্ণতা, অথণ্- তার পরিব্যক্তি। তার বাহিরও মিলেছে অন্তরও মিলেছে । অন্তর-বাহির, আপন-পর, ভেদ-মভেদ একাকার, একীভূত, একাত্ম হয়ে গেছে তার কাছে। মনে হত সোনাদি আত্মবোধের দীক্ষা বাবার কাছেই পেয়েছে বুঝি ! তারপর একে একে সবাই ভুলে গেল আমাকে । আমি যে একদিন লিখেছি, তা কয়েক বছর পরে আর কারো মনে থাকবার কথা নয় । আমার লেখক-জীবনের মৃত্যু হল। আমার মুক্তি হল। শুধু একজন ভোলেন নি। “দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাঝে মাঝে চিঠি দিতেন। লেখা চাইতেন। লিখতেন, “বিলাসপুরে গিয়ে বিলাসী হয়ে গেলেন নাকি 1” আমি কখনও সে-চিঠির উত্তর দিয়েছি, কখনও দেইনি । একদিন সোনাদি চিঠি লিখলে, তুই যে লিখছিস আবার, এখনো যে দ্রশ বছর কাটেনি তোর-__- কিন্ত কই, আমি তো লিখিনি। কিন্তু আমার একজন প্রতিবেশীই আমার ভূল ধরিয়ে দিলেন__ বললেন, “দেশ” পত্রিকায় আপনার একট। লেখ। পড়লাম, বড় ভালে। লাগলে ৷ বড় লক্জায় পড়লাম । সত্যি পত্রিক। খুলে দেখি আমিই লিখেছি । সে যে কী লজ্জ। কী বলবো! সম্পা্ককে চিঠি লিখল[ম, “এ কার লেখ। ছাঁপিয়েছেন আমার নাম দিয়ে ?, তখনে। কি জানি এ কেন হল | সম্পাদক ভয় দেখিয়ে লিখলেন, “আপনি যদি না লেখেন তে। আরো লেখা আপনার ন।মে ছাপা হবে-- কিন্তু কেমন করে প্রকাশ করবো- আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ! সোনাদিকে যে আমি কথ! দিয়েছি । দৌড়ে এলাম কলকাতায় । মনে আছে হাওড়া স্টেশন থেকে সোজ। সোনাদির বাড়ি গিয়ে হাজির। কিন্তু এই ক'বছরে এ- বাড়ির ভেতর-বাইরে ষে এমন পরিবর্তন হয়ে গেছে তা তো৷ টের পাইনি। ১৫৭ কন্তাপক্ষ বাড়ির বাইরে বাগানের সে-বাহাঁর নেই । নেই সেই ঘাসের কেয়ারি। নেই যত্ব-লালিত সেই ফুলের বাগান । সোনাদির ঘরে গিয়ে ধাড়াতেই কেমন ফাঁকা লাগলো সব। সোনাদির সেই আলমারি-ভত্তি বইগুলোর ওপর ধুলে৷ জমেছে । বিছানাটা তেমনি রয়েছে পাশে । সোনাদির বড় মেয়ে পুটু শুয়ে রয়েছে তার ওপর। আর সোনাদির সেই ইজি-চেয়ারটা ফাঁকা । রোজকার মতো সেই পরিচিত দৃশ্য আর নেই এখানে । অভিলাষ দেখতে পেয়েছে আমাকে । জিগ্যেস করলাম, “সোনাদি কোথায় অভিলাষ ? অভিলাষ বললে, “মা তো রান্নাঘরে ।, রান্নাঘরে ! শুনে অবাক্‌ হলাম। দাঁশসাহেবের বাড়িতে সোনা দিকে কখনও রান্নাঘরে যেতে দেখিনি । দাঁশসাহেবের খাঁনসাম1 বাবুচি ছিল । আবার ঠাকুর-চাকরেরও ব্যবস্থা ছিল সোনাদির জন্যে । সোনাদি ছুঃজনের হাতের রান্নাই খেয়েছে । পার্টিতে যখন বড় বড় ঘরের বউরা মেয়ের! আসতো, সোনাদিকে তাদের সঙ্গে সমান তালে ইংরেজী খানা খেতে দেখেছি, ইংরেজী কেতায় চলতে দেখেছি । শাড়িতে, গয়নায়, কেতা-ছুরস্তে সে যেন এক অন্য সোনাদি, আবার যেদিন স্বামীনাথবাবুর বৌবাজারের বাসায় অল্প-পরিসর রান্নাঘরের মধ্যে মাটির হাড়িতে ভাত রশাধতে দেখেছি সে-ও এই একই সোনাদি। অথচ সোনাদিকে আমি চিনেছি বলেই সোনাদির চরিত্রের বৈচিত্র্যের মধ্যে কোনও বিরুদ্ধতা পাইনি । কিন্তু দাশ- সাহেবের বাড়িতে এমনিভাবে এমন সময় রান্নাঘরে যাওয়ার ঘটন। সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো । মাঝখানে বিলাসপুর থেকে যখন আর একদিন কলকাতায় এসেছিলাম, সেদিনও এমন ছিল ন1। শুনেছিলাম, দাশসাহেব চাকরি ছেড়ে দিয়ে এক ব্যাঙ্ক খুলেছেন, ব্যাঙ্কের মালিক হয়েছেন। ব্যাঙ্কও খুব ভালে চলেছে । মনে আছে সে-এক ছুটির দিন। দাশসাহেব পাশে বসে খবরের কাগজ কন্তা পক্ষ ১৫৮ পড়ছেন, আর পাশের বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন স্বামীনাথবাবু। তখনও পুটুর অন্ুুখ ভালে হয়নি। রতি আর শিশু খেল করছে বারান্দায়। দাশসাহেব মুখ তুলে বললেন, “দেখো সোনা, কে এসেছে ?' স্বামীনাথবাবু উচু হলেন।--কী খবর হে? আমি ছু'জনকেই নমস্কার করলাম । সোনাদি আমাকে একেবারে পাশে বসালে টেনে । বললে, “কেমন আছিস ? দ[শসাহেব বললেন, “ও একটু রোগ। হয়ে গেছে, না সোন। স্বামীনাথবাবু বললেন, তুমি আমাকে দেখে অবাক্‌ হয়ে গেছ, না ? বললাম, “তখন শুনেছিলাম আপনি বেশিদিন থাকবেন না ? স্বামীনাথবাবু বললেন, “যাওয়ারই তো। সব ঠিক ছিল ভাই, ওই দেখে! ন|, দাশলাহেব যেতে দিলেন না ।, দাশসাহেব বললেন, “অনেকদিন তে। চাকরি করলেন আপনি, বিশ্রাম তো। করেননি কখনও । একটু না-হয় দিন কতক বিশ্রামই নিলেন | স্বামীনাথবাবু বললেন, “আপনার নিজের ব্যাঙ্ক, আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন, আমার হল পরের চাকরি ।” মনে আছে তারপর চ নিয়ে এল অভিলাষ । দাশসাহেবকে সোনাদির সামনে যেমন দেখতাম, তার ব্যাঙ্কে আবার ছিল অন্যরকম চেহারা । বিরাট ব্যাঙ্ক । বড়সাহেব বলতে ভয়ে কাপতো। সবাই। দরজা-বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে ঘণ্টার শব্দ হত আর চাপরাসী মহলে ছুটোছুটির পাল! পড়ে যেত। সবাই তটস্থ। সে আমি দেখেছি। আর স্বামীনাথবাবুর অফিস আমি দেখিনি, তবে শুনেছি সোনাদির কাছে । সোনার্দি বলতো, “অফিসে গেলে বাড়ির কথা মনে থাকে ন। ওর, আর বাড়িতে' এলেও আবার অফিসের কথা ভূলে যান--এমনি মানুষ কিন্তু স্বামীনাথবাবুকে দেখে বোঝা যেত না, অতবড় অফিসটা উনি ১৫৯ কন্তাপক্ষ চালান কী করে! সেই স্বামীনাথবাঁবুর নিজের হাতে রাঁধবার দৃশ্টটা যেন ভুলতে পারি না। আর দাশসাহেবের নতুন ছোট শোবার ঘরটায় গিয়েও দেখেছি। স্বামীনাথবাবুকে নিজের ঘরট। ছেড়ে দেবার পর এই ঘরটায় দাঁশস[হেবের থাকবার ব্যবস্থ। হল ৷ গোছান হল খাট, বিছানা, বই, কাগজ, কাইল। আর দেয়ালে টাঙানো হল সব ছবি। সবচেয়ে বড় ছবিটা ছিল মধ্যেখানের দেয়ালে । ছবিতে পাশাপাশি বসে আছেন দাশসাহেব আর সোনাদি। আর রতি আর শিশু । ছবিট। অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি ! মনে হয়েছে ছবিটা দেখে যে-কেউ সোনাদিকে দাঁশসাহেবের স্ত্রী বলেই ভাববে। কিন্ত যারা সোনাদির সঙ্গে মিশেছে তার! জানে, অতবড় ভূল সোনাদির শক্রও যদি কেউ থাঁকে তো তারাও করবে না। কিন্ত অবাক্‌ হয়েছিলাম আর-একটা। ছবি দেখে । সেট। টাঙানো ছিল স্বামীনাথবাবুর ঘরে। সেটাতেও সোনাদি বসে আছে স্বামীনাথবাবুর পাশে, আর সোনাদির পাশে পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে পু্টু। ছু'টে। ছবিতেই সোনাদি যেন স্ত্রী হয়ে বসে আছে। একই মুখের ভাব, একই চোখের দৃষ্টি, কোথাও কোনে তারতম্য নেই তার। কিন্ত এবার এ-বাড়িতে পা দিয়ে ষেন সব বদলে গেছে মনে হল। মনে হল, যেখানে য। থাকবার সে যেন নেই । সোনাদি দাশসাহেবের রান্নঘরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে রান্না করছিল । আমাকে দেখেই হাসিমুখে বললে, “কী রে, তোর সোনাদিকে মনে পড়লে। |, বললাম, “কেমন আছো, সোনাদি ? ভালোই তো আছি, কেন, কী রকম দেখছিস ? ভালে। করে সোনাদিকে চেয়ে দেখলাম । কোথাও ও-চেহারায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে কি! মুখের হাসির ভাষা কি কিছু কম মুখর, চোখের দৃষ্টির রং কিছু কম উজ্জ্রল! কোথাও তো! টের পাচ্ছি না! সোনাদি উন্নুনের ডেকৃচি নামিয়ে কড়া তুললে । খানিক পরে বললাম, “সোনাদি, তুমি।রাধছে। ? কন্তাপক্ষ ১৬৩ “কেন আমি রাধতে পারিনে ? বলে উন্ুনের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল সোনাদি। তবু যেন আমার ভয় গেল না। বললাম, “সত্যি বলো না, কী হয়েছে ? “হবে আবার কী রে, পাগল ছেলে 1, 'কিছু হয়নি- সত্যি? তবে খানসামা, বাবুচি, গীরালি, সুখ সিং, বি-রা, বামুনঠাকুর সব কোথায় গেল, কাউকে দেখতে পাচ্ছিনে যে 1, “ও? তাই বলছিস! তাঁদের তে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ।। ছাড়িয়ে দেওয়! হয়েছে! কেন?" “কেন আবার, দাশসাহেবের ব্যাঙ্ক যে ফেল্‌ হয়েছে, শুনিস নি? আমি যেন ভুল শুনছি । আমার মনে হল যেন স্বপ্প দেখছি চোখ মেলে। সোনাদ্দি আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে, “ট্রেন থেকে নোমে সোজ। আসছিস নাকি !। আমি কিছু উত্তর দ্রিতে পারলাম না । আবার জিগ্যেস করলাম, 'তাহলে কী হবে সোনাদি ? “কী আবার হবে? বলে সোনাদি আপন মনে রান্নাই করতে লাগলে! । বললাম, “সোনাদি, কথা বলো! ন। ? সোনাঁদি আমার পিঠে হাত দিয়ে সান্্ন। দিতে লাগলেো।। তারপর তেমনি রান্না করতে করতেই বললে, “কী কথা বলবো, বল ? মনে আছে এখনও, কী ভীষণ সে দিন ক'টা। দাঁশসাহেব নিজের বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছেন। মুখে কোনো কথা নেই । *টেলিফোনের পর টেলিফোন আসছে । কত লোক আসছে দ্রেখা করতে, কারে সঙ্গে দেখা করছেন ন। দাশসাহেব! অভিলাষ বলতো, “দেখা হবে না দাঁশসাঁহেবের সঙ্গে, সাহেবের অন্ুখ |; তারপর কত কী ঘটলো । সে কী ভীষণ অস্তরখ দাশসাহেবের ! ব্রাড- প্রেসার ছিলই, তারপর কেমন হল, আর বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে পারেন ১৬১ কন্ঠাপক্ষ না। সোনাদ্ি তার ওই ছুর্বল শরীর নিয়ে পাশে বসে চামচে করে খাইয়ে দেয়। বলে, “এইটুকু খেয়ে নাও- দাশসাহেব চুপ করে খেয়ে নেন। কিছু কথ! বেরোয় না তার মুখ দিয়ে। চুপ করে সব দেখেন। চোখের সামনে একে একে সকলকে ছাড়িয়ে দেওয়া! হল। অভিলাষকে ডেকে সোনাদি বললে, “অভিলাষ, সাহেবের অবস্থা তো দেখছ, তোমাকে মাইনে দিতে পারবো কিন। বুঝতে পারছি ন1।' অভিলাষ তবু যেতে চায় না। বলে, “অনেক নুন খেয়েছি সাহেবের, আমাকে আর তাড়িয়ে দেবেন না, মা) রতি আর শিশুও একদিন ইস্কুল ছেড়ে চলে এল। সেখানেও গঞ্জন। শুনতে হবে সকলের কাছে । খবরের কাঁগজেও খবরট বেরিয়ে গেছে। এক হাজার ছু-হাজার টাকার ব্যাপার নয়, লাখলাখ টাকাঁর কারবার । সব বন্ধ! সোনাদি রান্নাবান্না সেরে রতি আর শিশুকে নিয়ে পড়াতে বসে। বলে, “এবার থেকে আমি নিজেই তোমাদের পড়াবে। ।, আমি চুপ করে শুনি, দেখি সব। কী চমতকার সোনাদির পড়ানো । কী চমৎকার সোনাদির ইংরিজী উচ্চারণ। আর সেই হাসিমুখ । সেই হাঁসিমুখেই সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সোনাদির সংসারের কাজ। কাজ করতে ক্লান্তি নেই, বিরাম নেই! টেলিফোনের লাইনট। একদিন এসে কেটে দিয়ে গেল কোম্পানির লোকেরা । মোটরগাড়িট। ক্রোক্‌ করে নিলে । পুলিস দাশসাহেবকে কী সব জিগ্যেস করলে । অ্যারেস্ট করে জামিনে খালাস করে দিয়ে গেল। সমস্ত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে নিলে । নিঃস্ব নিরাভরণ বাড়িঘর। সোনাদি একটা একট করে গয়না খুলে দিতে লাগলো । শুধু সোনাদি আর অভিলাষ ! আর তিনটি শিশু-_দাশসাহেব, রতি আর শিশু । আমি এক সগ্চাহের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম, আরে। একমাস বাড়িয়ে ছুটির দরখাস্ত করে দিলাম । আমি জিগ্যেস করতাম, “কতদিন এমনি করে চলবে, সোনাদি ? ৯১ কন্তাপক্ষ ১৬২ সোনাদি তেমনি হাসতো। বলতো, গালাবার মালিক কি আমি, আমায় যে জিগ্যেস করাছস ?' “তোমাকে জিগ্যেস করবো না তো। কাকে জিগ্যেস করবো আমি ? সোনাদি দাশসাহেবের ভাত বাড়তে বাড়তে বলতো, “এতদিন যেমন করে চলেছে, তেমনি করেই চলবে । ওদিকে পুলিস আসে, লোকজন আসে, সোনাদি তাদের সঙ্গে কথ! বলে। কী স্পষ্ট কী ভদ্র, কী শান্ত ব্যবহার। দাশসাহেবকে আড়ালে রেখে সোনাদি এগিয়ে আসে সামনে । আড়াল করে রাখে রতিকে শিশুকে। কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। কিন্তু বুঝতে! সবাই। আস্তে আস্তে সোনাদির সমস্ত দেহ নিরাভরণ হয়ে আসে । তবু সোনাঁদির মুখের হাসি তেমনি অয়ান। মনে আছে তখনো কতদ্রিন, যখনি অবসর হয়েছে, সোনাদি ইজি-চেয়ারে বসে আমার সঙ্গে গল্প করেছে । সেদিন সকাল-সকাল সোনাদির বাড়ি গেছি, হঠাৎ বাড়ির সামনে এসে দীড়াল একটা ট্যাক্সি আর নামলেন স্বামীনাথবাবু। সোনাদি বললেন, “তুমি ? ব্বামীনাথবাবু বললেন, খবরের কাগজে সব দেখলাম, তা দাশসাহেব কোথায় ? সোনাদি বললে, “গই ঘরে দেখো গে, শরীর খারাপ এঁর, বড় মন-খারাপ হয়ে গেছে। স্বামীনাথবাবু জিগ্যেস করলেন, “কেন এমন হল হঠাৎ ? সোনাদি বললে, “কেন হল তা কি আমি জানি? আগের দিনও অফিসে গেছেন, টেলিফোন করেছেন, যেমন রোজ খান তেমনি ছু'শ্লাইস ব্রেড আর টোম্যাটোর সস্‌ খেয়েছেন, বিকেল তিনটের সময় টেলিফোন এল, বললেন, “আমার বাড়ি যেতে একটু দেরি হবে-, স্বামীনাথবাবু বললেন, “তারপর-” সে গল্প সোনাদি আমাকেও বলেছে। ডালহোৌসি স্বোয়ারে লোকে ১৬৩ কন্াপক্ষ লোকারণ্য । হাজার হাজার লোক ব্যাঙ্কের সামনে চীংকার করছে। ব্যাঙ্কের কোল্যাপসিবল গেট বন্ধ করে দিয়েছে । কত লোক সেই দেয়ালের পাথরের ওপরই মাথা কুটছে। দাঁশসাহেব আট্‌কে পড়লেন অফিসের কামরায় তারপর টেলিফোন করলেন সোনাদিকে । সোনাদি টেলিফোন ধরে বললে, “বাড়ি চলে এসো এখুনি |: “এখন যাওয়। অসম্ভব, ওর সমস্ত রাস্ত। জুড়ে দাড়িয়ে আছে, আমাকে বেরোতে দেবে না-সমস্ত রাস্তা বন্ধ ৷; সোনাদি বললে, “আমি যাচ্ছি এখুনি, গাড়িট। পাঠিয়ে দাও ।। তুমি এসো! না সোনা, তোমাকেও এরা বাধা দেবে, আসতে দেবে না।, তবে আমি ট্যাক্সি করে যাচ্ছি" বলে টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে উঠলো সোনাদি। সোনাঁদি বললে, “দাশসাছেবকে কি বা'র করে আনতে পারি সেদিন, হাজার হাজার লোক গেটের সামনে দাড়িয়ে, আমি ট্যাকি থামিয়ে সোজ। ভিড় ঠেলে গিয়ে উঠলুম, তারপর কেমন করে যে দাশসাহেবকে নিয়ে আবার বাড়িতে এলুম, তা আমিই জানি। কিন্ত সেদিন রাত্রেই দাশসাহেব বিছানায় পড়লেন, দেখে এসে গিয়ে, আর উঠতে পারেন না, আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে হয়__” তারপর সে-ক*দিন স্বামীনাথবাঁবু কী পরিশ্রমই করলেন। যে-ক'দিন ছিলাম সেবার, দেখেছি স্বামীনাথবাবু সারাদিন কোথায় কোথায় যান। উকীল, ব্যারিস্টার, আযাটনি, সলিসিটর। জলের মতো টাক! খরচ করেন । বি-চাকর যাদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল আবার 'রাখা হল। সুখ সিং আবার এসে গেট-এ দাড়ালো । সোনাদির পুরনো বি-রা আবার এল। স্বামীনাথবাবু নিজের ব্যাঙ্ক থেকে টাক তুললেন। সারাজীবনে যা কিছু জমিয়েছেন পুঁটুর বিয়ের জন্যে, কলকাতায় বাড়ি করবার জন্যে কয়েক হাঁজার টাক! আলাদা করা ছিল, তা-ও সব তুলতে হল। স্বামীনাথবাবু বললেন, "ঠিক আগে যেমন ছিল, তেমনি চলুক, কোথাও যেন ক্রটি ন। থাকে ।' কন্তাপক্ষ ১৬৪ আমিও উকীল ব্যারিস্টারের বাড়ি ঘোরাফেরা! করতে লাগলাম । একা! স্বামীনাথবাবু কত পারবেন। দাঁশসাহেব বিছানায় শুয়ে বললেন, 'সলিসিটরর। কী বলেছে ?” “সে সব আপনি ভাববেন না, আমি তো আছি-_ তারপর যখন সারাদিনের কাজের পর স্বামীনাথবাবু বাড়ি আসেন, তখন টেবিলে গোল হয়ে বসে আবার সভ। হয়। আসর আবার জমে | সোনাদি বলে, “পুটু, খাচ্ছে! না তো ?, পুঁটু মুখ কীচু-মাটু করে বলে, “ক্ষিদে পাচ্ছে না যে মা? স্বামীনাথবাবু বলেন, “আজকেও আবার পেয়ার! খেয়েছে বোধহয় ? সোনাদি জিগ্যেস করে, “কতদিনের ছুটি নিলে তুমি ? স্বামীনাথবাবু বলেন, “এ-ব্যাপাঁরটা না মিটলে তো৷ আর যেতে পারি না।” সোনাদি আবার জিগ্যেস করে, “নয়ন কী রকম কাজ করছে ওখানে ? “ও বলছিল, আর ছু'টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিতে__ “আর ছুধটা দেখে নেওয়া হয় তো এখনো ? “সব তে। শনিচরীর-মা করে, ওর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি | পুঁটু তো লেখাপড়া কিছু পারে না, দ্বিতীয় ভাগের বানানও সব ভুলে বসে আছে! পুটুকে তুমি তোমার কাছেই রাখো এখানে |, এক-একদিন স্বামীনাথবাবু এসে জিগ্যেস করেন, 'দাশসাহেব কেমন আছেন আজ ? “সেই রকমই ।__কিছু সুরাহ হল ? স্বামীনাথবাবু জাম! ছাড়তে ছাড়তে বলেন, “সুরাহা হবে বলেই তো! যেন মনে হচ্ছে এবার।: “সলিসিটরকে কত টাঁক1 দিলে আজ ? “আগে য। দিয়েছিলাম “তার পরে আজকেও আবার চেক্‌ দিলাম ।, কতদিন আর চলবে কেস? “যত বছরই লাগুক, চালিয়ে তো যেতেই হবে ॥, ১৬৫ কন্তাপক্ষ ৫ 'আর কতদিন এখানে থাকবে ?, ছুটি আরো বাড়িয়ে নিয়েছি, তা৷ জববলপুরের বাঁড়িটার জন্যে একটা পার্টি এসেছিল আজ-_, কত দর দিতে চায় ?-**, তা আমি বেশিদিন থাকতে পারিনি সেবার। দাশসাহেবের মামল। তখনও চলছে । বিলাসপুরে এসে আবার 'চাকরিতে যোগ দিয়েছি । সোনাদিকে চিঠি দিয়েছি । ঠিক ঠিক জবাব এসেছে প্রত্যেকবার। প্রত্যেক- বারই সোনাদি লিখেছে, “লেখার কথ। ভূলে যাসনি তো ? লেখার কথা কি ভুলতে পারি! পাঠকর! আমাকে ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি তাদের । ..যুদ্ধের বাজারে কত রকম পত্রিকা বেরোলো'। কত নতুন প্রতিভাকে নিয়ে মাতামাতি হল। আমি তবু ভুলিনি। আমি ভুলিনি আমার সোনাদির কথা । সোনাদিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথী। আমি জানি আমার পথ সামনে, আমার পথ অদূরে । আমার মধ্যে সংশয়রহিত আমি। আমি সেই একটি একককে পেয়েছি। একেবারে রসরূপে, আনন্দরূপে, অব্যবহিতভাবে পেয়েছি । এজানা নয়, সংগ্রহ নয়, জোড়া- তালি দেওয়া নয়__-এ প্রকাশ। সর্ষের প্রকাশের মতো ভাম্বর। সে- প্রকাশকে খুজতে বাইরে যেতে হবে না । কারো দরজায় গিয়ে খোসামোদ করতে হবে না। হাটে বাজারে গিয়ে খুঁজতে হবে না। শুধু অন্তরের জনালা-দরজাগুলো খুলে দিলেই সে-আলো! একেবারে অখণ্ড হয়ে উদ্ভাসিত হবে। সোনাদি আমাকে দিনের পর দিন সেই দীক্ষাই দিয়ে এসেছে। কিন্ত আশ্চর্য, সোনাদিই তা দেখতে পেলে না। সোনাদিকেই দেখাতে পারলাম না শেষ পরধন্ত, এ-ক্ষোভ আমার রাখবার জায়গা! নেই । একদিন হঠাৎ স্বামীনাথবাবুর চিঠি পেলাম । লিখেছেন, «সানা তোমায় দেখতে চেয়েছে একবার, চলে এসো শিগগির; . কী জানি চিঠি পেয়ে বড় উৎকঠা হল। ছুটে এলাম কলকাতায় । মনে আছে, সোনাদির আগের চিঠিতে জানতে পেরেছিলাম-দাঁশ- কন্তাপক্ষ ১৬৬ সাহেব মামল। থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু সে-যুক্তির মানে যে কী, তা আমি আন্দাজ করতে পারতাম । দাঁশসাহেবের মুক্তির জন্যে স্বামীনাথ- বাবু জীবনের যাঁ-কিছু সঞ্চয় যাঁঁকিছু সামর্থ্য সমস্ত ব্যয় করেছেন। জববলপুরের বলতবাঁড়িটাঁও বাঁধ! দিয়েছেন। ,এমন কিছু ছিল না যা! দেননি। প্রয়োজন হলে বাকী সবকিছুই তিনি দিতে পারতেন। তারপর যখন সমস্ত দিকে সুরাহ! হয়েছে, দাশসাহেব সেরে উঠেছেন, আবার ছেলে-মেয়েদের ইস্কুলে ভতি কর! হয়েছে, আবার সোনাদি যখন স্বামীনাথবাবুর কাছে জববলপুরে ফিরে যাঁবার কথা৷ ভাঁবছে--এমন সময় এমন কী কাণ্ড ঘটলো ! গিয়ে দেখলাম-_সমস্ত বাড়িতে একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়া! তবু বাগানের চেহারা! আবার ফিরেছে । গেট-এ আখ সিং ঈাড়িয়ে ছিল । সেলাম করলে আমায়। বললে, “মাঈজীর বড় বেমার--, আমি গিয়ে দাড়ালাম সোনাদির ঘরে । সোনাদি শুয়ে ছিল। যেন চিনতে পারলে আমাকে । যেন হাসলো । যেন দৃষ্টি দিয়ে কাছে ডাকলে । কাছে গেলাঁম। দীশসাহেব মাথার কাছে বসেছিলেন। এ-পাশে স্বামীনাথ- বাবু দ্াড়িয়েছিলেন শুকৃনো মুখে । আর, একজন ডাক্তার কী যেন লিখছিলেন একটা কাগজে । ওষুধে-পত্রে ছেয়ে গেছে টেবিল। সেদিনের সব কথ! আজ আর বলবার দরকার নেই। সব কথা আমি ছাড়া আর কারো হয়ত মনেও নেই । তবু মনে আছে যখন সব শেষ হয়ে গেছে, তখন স্বামীনাথবাবু শান্ত-নিপ্ধ চোখে সোনাদির প্রাণহীন দেহটার দিকে উদার দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। কিন্তু দাশসাহেবের অবস্থা বড় করুণ। ছেলেমান্থুষের মতে। আছড়ে-পিছড়ে কাদতে লাগলেন । তাকে সবাই মিলে ধরেও থামানো যায় না এমনি অবস্থা তার। মনে আছে স্বামীনাথবাঁবু বলেছিলেন, 'দাঁশসাহেব বড় কাতর হয়ে পড়েছেন__ওকে তুমি দেখো দাশসাহেবও মনে আছে বলেছিলেন, “ম্বামীনাথবাবুর কাছে গিয়ে একটু বোসে ভাই তুমি, ওঁর শোকটাই দারুণ__* ১৬৭ | কন্ত(পক্ষ আর আমি ! স্বামীনাথবাবু এখনও জববলপুরে ৷ দাঁশসাহেব সেই ব্যাঙ্ক ফেল পড়বার পর আর-একটা! ব্যাঙ্ক করেছেন কলকাতায়। তাদের সঙ্গে আমার আর কোনও যোগাযোগ নেই আজ । তার! কী পেয়েছিলেন জানি না । ছু'জনের ঘরে গিয়েই দেখেছি ছুটো বড় বড় ছবি। একটা ছবিতে দাশসাহেবের সঙ্গে সোনাদি, আর একটা ছবিতে স্বামীনাথবাবুর সঙ্গে। কতবার ভেবেছি, সোনাদির কাছে কে সব চেয়ে প্রিয় ছিল ! স্বামীনাথবাবু, দাশসাহেব, না! আমি! আমার কথা ওঁরা ছু'জনেই হয়ত কখনে। ভাবেননি । কিন্তু ওর! য! পেয়েছেন, তার চেয়ে যে কত বেশি পেয়েছি আমি । আমার পাওয়ার যেন শেষ নেই! আমি যে আশাতীত পেয়েছি । সোনাদিকে পেয়েও পেয়েছি, হারিয়েও পেয়েছি । জীবনের মধ্যে দিয়ে পেয়েছি, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পেয়েছি । এই যে আজ অন্তরের সঙ্গে বাইরের, আচারের সঙ্গে ধর্মের, জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির, বিচারশক্তির সঙ্গে বিশ্বাসের সামপ্তস্ত করতে পেরেছি--এ তো! সোনাদিরই শিক্ষা ! আজ আমার জীবনে অন্তর মিলেছে, বাহির মিলেছে, সুখ মিলেছে, হুঃখও মিলেছে । শুধু যে জীবন পেয়েছি ত। নয়, মৃত্যুও পেয়েছি । শুধু বন্ধুই নয়, শক্রও পেয়েছি। তাইতো আমার জীবনে ত্যাগ আর ভোগ ছুই-ই পবিভ্র লাভ আর ক্ষতি দুই-ই সার্ক। সমস্ত সুখ-ছুঃখ, সম্পদ- বিপদ, বিরহ-মিলনের সার্থকতা আমার জীবনে নিটোল হয়ে একটি অখণ্ড প্রেমের পরিপূর্ণতায় এক হতে পেরেছে । প্রশংসাও যেমন পেয়েছি, নিন্দাও পেয়েছি তেমনি। তবু আমার প্রাপ্য বলে আমি ছু"টিকেই গ্রহণ করেছি। আমি বলতে পেরেছি, সমস্ত লোক-লোকান্তরের উধ্ব৫ে নিস্তব্ব-বিরাজমান্‌ হে পরম-এক, তুমি আমার মধ্যে এসে আমার হও !, তারপর আমার অজ্জাতবাসের পালা শেষ হল একদিন। মনে আছে আবার কাঁগজ-কলম নিয়ে বসলাম । এবার অনেক দূরের যাত্রা! এবার বৃহতের দিকে আমার লক্ষ্য । আমি স্থিতধী হয়েছি। সোনার্দি আমায় কন্তাপক্ষ রিভির সত্যবৃষ্টি দিয়ে গেছে । আমার তৃতীয় নেত্র খুলেছে। আমি নতুন করে জন্ম নিলাম । আমার নতুন উপন্যাসের সেই হল গোড়াপত্বন। আগেকার সব লেখা বাতিল হয়ে গেল। সোনাদির সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনের একটা অধ্যায়ের এখানেই পড়লো। পূর্ণচ্ছেদ ।